Sunday 10 September 2017

আশ্চর্য্য ধারাবাহিকঃ হারিয়ে যাওয়া নব্বই - প্রথম পর্ব

Image result for hide and seek abstract painting



প্রান্তিক রুদ্র পতি
                                                         -অনিন্দ্য রায় 

তখন নব্বই, আমাদের নব্বই দশক। আমরা কজন লিখতে শুরু করেছি, কজন বন্ধু । যেই কবিতা লেখে, বাংলা কবিতা লেখে তখন সেই আমাদের বন্ধু;  স্বরূপ, উজ্জ্বল, শুভব্রত, জয়দীপ, আমি, প্রদীপ – কত যে নাম, এই শহরে বন্ধুত্বের, কবিতার এক ভিন্নতর যাপন তখন একটা নেশার মতো আমাদের চোখেমুখে।
 তো, একটা ছেলে পাশের জেলা পুরুলিয়া থেকে একদিন এল স্বরূপের বাড়ি। বাঁকুড়ারই এক কলেজে পড়ে। লাজুক, মুখ নামিয়ে কথা বলে। রুদ্র,  ও লেখে রুদ্র পতি নামে। আরে, এ সেই রুদ্র পতি, পত্রিকা খুললেই, যে কোনো বাংলা কবিতার কাগজ খুললেই তো এর কবিতা, হ্যাঁ, থাকবেই। একেবারে নিজস্ব এক লেখার ভঙ্গি, একেবারে নিজের ভাবনা লেখাগুলিতে।
 ওর গ্রামের নাম রখেড়া, আমাদের জেলার সীমান্তে। সেই গ্রামজীবনের কথা, গ্রামের মানুষগুলির কথা, তাঁদের বেঁচে থাকা, চাষবাস, দুঃখ-সুখ, এক আশ্চর্য পৃথিবী ফুটে ওঠে ওর কবিতায়। আর এক সরল অথচ গভীর, আবেগতাড়িত অথচ প্রশান্ত, আবহমান অথচ নতুন উচ্চারণে বাংলা কবিতার পাঠক তখন আক্রান্ত।
 সেই রুদ্র পতি, এত লেখে, এত বেশি বেশি লেখে, এত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জীবনকে দেখে আমরা অবাক হয়ে যাই। প্রতিনিয়ত কবিতায় ভোগা সেই রুদ্র আমাদের বন্ধু হয়ে উঠল।
 প্রকাশ পেল তার কবিতার বই, প্রথম কবিতার বই ‘প্রান্তিক চাষা’। ২টি টাইটেল পেজ সহ ১৮পৃষ্টার। সিন্ধুসারস প্রকাশন। দাম ঃ লেখা নেই। হ্যাঁ, বইটিতে দাম ও প্রকাশকালের কোনো উল্লেখ নেই।
 কি বলতে চাইল সে? কোনো অর্থমূল্য ও সময়চৌহদ্দি হয় না কবিতার! ( যদিও জানি যে বইটি বেরিয়েছিল ১৯৯৩-এ )
রচনাকাল ঃ ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ ।
উৎসর্গ ঃ নারায়ণ মুখোপাধ্যায়
  অনির্বাণ লাহিড়ী
এই দুটি নাম বাংলা কবিতার কোন্‌ ঘরনার প্রতি তার আকর্ষণ তা বুঝিয়ে দেয়।
দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় বিভাব কবিতায় সে লেখে
“ ওই তো কপাল দ্যাখো
 দারিদ্রের রেখাগুলি আঁকে আর বাঁকে

 আহা ! ওই রেখাগুলি যদি নদী হতো

আজও তোর চোখে মুখে গ্রামের ছায়া পড়ে বলে
ধানফুল জড়ানো
চিঠি আসে – যার ভেতর বাহির একাকার ।

আজো গ্রাম আছে তাই সরলতা ।”
এমনই তার কবিতা, এমনই তার ধানফুল, তার চিঠি, তার গ্রাম, তার সরলতা।
তার কবিতা।


“ পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছো ;
 পুকুর আয়না হয়ে গেছে, অই দ্যাখো
 তোমার প্রতিফলিত ছায়া বাঁশবনের পাতায় পাতায়

 চাঁদ উঠেছে অই, গোল থালার মতো চাঁদ
 আজ আলোড়ন ... পূর্ণিমা রাত্রি
 দেখি, পুকুর ফিরিয়ে দিচ্ছে চাঁদের বিম্ব
তোমার সিঁথি ও কপালে ।

 তোমার আজ পুরুষের কথা মনে পড়ে, পড়ে ?”
        ( বিরহ )
এই তার কাব্যভাষা। এক অচঞ্চল চিত্রকল্পের মুখোমুখি দাঁড় করায় পাঠককে। কোলাহলহীন, স্তব্ধ ।
কৃষিভিত্তিক গ্রামগুলি, আমাদের দেশে, নিতান্তই প্রকৃতি নির্ভর। চাষআবাদের জন্য আকাশের বৃষ্টির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। আর গ্রীষ্মের রুক্ষতা, শ্রাবণের ঝরঝর মানুষের শরীরের যেন মিশে যায়, ঝড় বা দাবদাহ, বন্যা বা খরা তার দেহের ভাষা হয়ে যায়।
“ অথচ আজ শ্রাবণ যায়
 এই মাঠ হল না পিচ্ছল

শুধু দেখি আমাদের চোখগুলি
হয়েছে পিচ্ছল”
( অনাবৃষ্টি )
দেহতত্ত্ব, এই মাটির, মানুষের অন্যতম সম্পদ তার লেখায় এভাবে মিশে যায়। লোকায়তের ঘরেই তো তার বসত ।
“ টুসুর গানে আজ স্রোত ছেড়ে দিচ্ছি
 মানুষের স্রোতে আজ
মাঠ ছেড়ে মেলাতে চলেছি ।

নদীর ওপারে মেলা, কাঁসাই নদীতে
আজ হাসি, সমস্ত বিষণ্ণতাগুলি
 ভেঙে গেছে ... ; মেলায় মহুয়া খাবে
 গরম জিলিপি খাবে তামাটে মানুষ ।

আজ স্রোত, জাগরণ এবং বেঁচে থাকার আনন্দগুলি
হঠাৎ কীভাবে যে মেলায় গড়ালো !

পৌষের শেষ দিন, আজ শুধু মেলায় অবগাহন ।”
সে সন্ধান করে তার শেকড়ের, লেখালেখি তার কাছে তাই নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মাধ্যম। নিজের সাথে কথা বলার আড়ালটুকুই কবিতা। সে ভনিতাহীন, সে অকপট, অন্তর্মুখী ।



“চাষ করি কেটে খাই ।  এ বছর শ্রাবণ বিমুখ
তাই দারিদ্র রেখার ওপর দিয়ে হেঁটে যাই
শহরে জন খাটি, এ জনমে নিজ কর্ম করি ।

গত বছর ধান বিক্রি করে শহর থেকে
বাবার ধুতি মায়ের কাপড়
কিনে এনেছিলাম

এ বছর স্বপ্নে বহ্নি, তবু বেঁচে থাকি । স্বপ্নে সপ্‌নে”
( প্রান্তিক চাষার ছেলে )
 কবিতা মঞ্চের আলোকবৃত্ত থেকে দূরে এক প্রান্তিকে, নাগরিক জটিলতার রৌদ্র থেকে দূরে এক সারল্য ছায়া্য, সফলতার বিকৃত  উল্লাসের বিপরীতে এক চুপকথায় নিজেকে, নিজের অবস্থানকে চিহ্নিত করে সে। হ্যাঁ, প্রন্তিক চাষা, এই পরিচয়ে সে কবিতাকে স্পর্শ করে।
 প্রান্তিক যাপনের ভেতরে যে ব্যপ্ত গভীরতা তাতে মগ্ন থাকে সে।
এত এত লিখে হঠাৎ সে কবিতা থেকে সরে যায়। ফিরে আসে। আবার এক নিশ্চুপ আঁধারে ডুবে যায়। কোন অভিমান তাকে ডেকে নিয়ে গেল !
 আই টি আইতে কারিগরি শিক্ষা নিয়েছে সে পরবর্তীতে। এবং শিক্ষকতা তার পেশা।  প্রকাশিত হয়েছে আরও কাব্যগ্রন্থ, ‘লেদ অথবা অসম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন’ ( ১৯৯৩), এ বছর শ্রাবণ ভালো ( ২০০৪), বেকারের কবিতা ( ২০০৪ ) ।
 কিন্তু তার এই প্রথম কবিতার বইটি, কৃশ ও তীক্ষ্ণ কবিতার বইটি তার আইডেন্টিটি হয়ে রয়ে গেছে আমার কাছে।
 আমার সাথে তার যোগাযোগ রয়ে গেছে, বন্ধুত্ব রয়ে গেছে। এক বছর, দু বছর পর দেখা হয় কখনো, কথা হয় কখনো।
 শুধু কেউ কাউকে চিঠি লিখি না আর।
 তার ঠিকানা, সেই পঁচিশ বছর আগের মতোই মনে আছে আমার।
রুদ্র পতি
গ্রাম ও পোস্ট ঃ রখেড়া
জেলা ঃ পুরুলিয়া
 ডাক সূচকঃ ৭৩২১৩০
আপনি, পাঠক, এই ঠিকানায় চিঠি লেখেন যদি, প্লিজ, একটু বলবেন সে যেন কবিতায় ফিরে আসে।


(ক্রমশ)

ছবিঃ স্টালমান

No comments:

Post a Comment