Saturday 25 May 2019

অনুবাদঃ আসামের ডিমাসা কবিতা

Image result for may day in painting

কুলেন্দ্র ডাউলাগুফু


সিপাহি পত্নীর ব্যথা  : একটি পত্র 


আজ মেঘলা দিনে
ভীষণ  মনে পড়ছে তোমাকে আমার
ডিয়ুং-এর এই উজান থেকে।
ডিয়ুং নদী পেরিয়ে,  হায়ুং পাহাড় ডিঙিয়ে
পৌছবে কি পৌছবে না
আমার চিন্তার বার্তা এখান থেকে?
আমি কোথায় তুমি কোথায় -
এমন হল কিসের জন্য?


পিছনে তাকালে
মনে পড়ে, নিঃশেষিত হাওয়া
আনন্দে গাওয়া সে দিনগুলো,
শেষ -হয়ে -যাওয়া
হাসিখুশিতে নাচা সে রাতগুলো!
হৃদয় ব্যথায় ভরে যায় সেদিনকার কথাগুলো ভাবলে
বড় দুঃখ হয় সেদিনকার স্মৃতিগুলো স্মরণ করলে!

ওয়াকু গ্রামের তুমি যুবকদের নেতা আমি যুবতীদের নেত্রী
থাকার দিনে
আমরা
হরিণের মত ছিলাম, নেচে দৌড়ে
ছিলাম,প্রজাপতির মত উড়ে- উড়ে
খেটে খাবো বলে হয়েছিল ভালোবাসা
কাপড় বুনে পরব বলে বেঁধেছিলাম ঘর ও।
তবুও
সময় যায় বদলে—ভাবার মত হয় না এ পৃথিবীতে।
জুম ক্ষেতে ফলে না ফসল
জাল ফেলে মেলে না মাছ
হরিণ শিকারে মেলে না হরিণ
শ্রমের বিনিময়ে মেলে না শ্রম
পেট ভরে ভাত খেতে পাই না, আমাদের এই রাজ্যে।
একদিন
সংসারের মাঝদরিয়ায় আমাকে একা রেখে,
দূরের পথে গেলে চলে তুমি সিপাহি হয়ে
সোনালী দিন আসবে ভেবে, রুপোলী রাত আনবে বলে,


তুমি চলে গেলে রণাঙ্গনে
আমি রইলাম চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে!


তুমি চলে গেলে
আর এখন, তোমার গ্রাম পড়ছে মরছে
আমাদের ঘরের ছোট বাগান
গেছে ভরে কাঁটা ঝোপঝাড়ে।
রোজই ভাত খাবার সময় একটি থাল থেকে যায় অতিরিক্ত
চুল আঁচড়ানোর সময় চিরুনির সংগে লেগে আসা পাকা চুল
তুমি নেই
আমার পৃথিবী অন্ধকার—রাত, দিন ও রাত—চাঁদকে দেখিনা রাতে ও
নিজের ছায়াই হচ্ছে আমার সাথী, থাকার জন্য একা রোজ।
ঘুমেও কাটাতে পারিনা রাত, কাজেও শেষ হয়না দিন—
কী ভাগ্য নিয়ে এসেছি আমরা
জানিনা আমি।


আজ ভোরে
শরীর ভীষণ শিরশির করে ওঠে
গ্রামের বাড়িতে পেঁচার ডাক শুনে,
আমার চোখ ফুলে উঠছে তোমার কথা ভেবে ভেবে!
দূরদেশে গিয়েছ রণাঙ্গনে- খারাপ কিছু কি যায় ঘটে
ভয়ে বিহ্বল আমার হৃদয়— কোনো বিপদ হবে না তো!


তুমি এস ফিরে, তাড়াতাড়ি!
তুমিই মাঝদরিয়ায় মহাপাথর
তুমিই মাঝপথের মহাগাছ,
চাইনে আমার সোনার বালা,চাইনে রুপোর মালা,
তুমি নেই আমি ও নেই, তুমি থাকলেই আমি ও থাকব
শীঘ্র ফিরে এস, ধানের বীজ বপন করবে এসে— পৃথিবী গোল


মূল ডিমাসা থেকে অনুবাদ- বিশ্বজ্যোতি বর্মণ


ছবিঃ কাসান্দ্রা তন্দ্রো 

বৈশাখের কবিতা ৯

মেঘলাকলোনি
                      -সৌমনা দাশগুপ্ত

যতদূর যাও না কেন
এই কাফিলা তোমার
পেছন পেছন যাবে

এই হাওয়াভর্তি শ্যালো পাম্প, এই একফসলি জমিন নিয়ে আর কতটা কৃষিকাজ হবে! জলখেলা মাটিখেলা আবোদা বালক। ফুল ছিঁড়ে উড়িয়ে দিচ্ছি, ইচ্ছে ধরে টান মারছি, পিঁপড়ের হাঁটার পথে চিনি ঢেলে, পরক্ষণেই ঢেলে দিচ্ছি জল। ইচ্ছে আমার বিষগোখরো দিগন্ত। ইচ্ছে আমার ভলকানিক স্রাব, কতটা পুড়লে পরে ছাই, আমি তার হদিশ রাখি না। শুধু জানি শ্যামাপোকা বারবার আলো দেখে ছুটে যায়, শুধু জানি পিঁপড়ের পাখা। মিছিমিছিই একটা আকাশ এনে টাঙিয়ে দিলে। আর শোনো হে গোঁসাই, কথা শুধু তোমার নয়, আমারও দু একখানা বাখান আছে, আছে তিন তিন সপ্তক জুড়ে সুর। আকাশকে সারফেস ভেবে নিয়ে আমি যে এই ছ ছখানা প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখছি, তুমি কী খবর রাখো তার, তুমি কী সেই আলোর নিচে খুলে ধরছ তোমার প্রথম প্যাপিরাস! এই যে এত এত ভরে দিলাম গানপাউডার, তবুও কাগজের এই হাওয়াইজাহাজ আর উড়ছে না

বৈশাখের কবিতা ৮

দেওয়াল-লিখন 
                     - নীলাব্জ চক্রবর্তী



দেওয়াল-লিখন বরাবর একটা লোক হেঁটে
একটা রাস্তাই তো
একটা দিক
তোমার মুদ্রায়
আঙুলছাপের মতো
পোলিটিক্যাল একটা সকাল
তেকোনা
ভাঁজ-খোলা ঠাণ্ডা মাংসের পাশে
অসঙ্গতিগুলো ভাবতে ভাবতে
এইখানে ভাষাটা
পরিণত হয়ে ওঠা
একটা তেষ্টার দৃশ্যে
ভিজে যাচ্ছে
স্রেফ যৌনতা অবধি
একটা ফিকে ক্যালেণ্ডার
গড়িয়ে...

বৈশাখের কবিতা ৭

প্রয়াত ভোরের স্মৃতিতে
                                      -পিয়াস মজিদ

প্রয়াত কুয়াশাময় এক ভোরের চিতা
মিহিমধু জ্বলে আছে এই বিষবুকে।
পৃথিবীতে প্রেমের কবিতা সব
ফিকে হয়ে আসে,
তবু ফিরে ফিরে কেন ফিঙে ডাকে!
গুচ্ছ গাছের সবুজে
আমাদের আমূল অন্ধতার অনুবাদ,
তুমি কি মরচে পড়া চোখ খুলে
কখনও পড়বে
ইন্দ্রজাল-ব্রেইলে?

যখন জলরুদ্ধ নদীতে
মরুভূমি শাখা মেলে,
শীতকালও একদিন
শেষ হয়ে আসে,
শুধু এক হিমপাখি
ঊষর মরুতে বসে,
উড্ডীন ভাষার বইয়ে
ত্রস্ত চঞ্চুর
কাতর কলমে
কুয়াশামাখা সেই
প্রেমের কবিতাই লেখে...

বৈশাখের কবিতা ৬


দহন
      -সম্পিতা সাহা

মুলাকাত আসলে একটা আস্তরণ।
অবনত ভাষা পুষে রেখে গাঢ় হয় নিস্তব্ধতা,
আর মনমতো কথা না পেয়ে
ফের অস্থির হয়ে উঠি ভেতর ভেতর।

একটা অন্তর্বর্তী বিস্মৃতি
আলোসাম্পান থেকে দূরে
ঈশ্বর জন্মের অপেক্ষা নিয়ে
আরও কয়েকমাস প্রচ্ছন্ন ব্যথা মেখে থাকে...

অথচ দেখো,
স্পর্শের চেয়ে স্বচ্ছ কিছু হয়না জেনেও
আমরা সেই জলকেই সহজলভ্য করে তুলেছি...



বৈশাখের কবিতা ৫

এ শহরে শুধু গ্রীষ্মের ক্যালেন্ডার বিক্রি হয়
                                                      -জয়ীতা ব্যানার্জী

(১)

ডায়রির ভাঁজে নামা চিঠির বিকেল
এ কথা যখনকার, ফুটপাথে রিলের ক্যাসেট কিনতাম

আমাদের গ্রীষ্ম মানে জমা-খরচের মেঘ
রৌদ্র থেকে রোদ্দুর হতে চাওয়া অমলকান্তিদাদা

ছুটির দুপুর, মুর্শেদ চাচার হাঁক
আর তার দানবের মতো সাইকেলে,খাঁচায়
স্কেচ পেন-এ লেখা 'হরেক মাল ৩০/-'

লোহার রডের ঘায়ে অদ্ভুত শব্দ তুলে তিনি পেরিয়ে যেতেন
ছাতিমের সারি,বারোয়ারি আমের উঠোন

এ কথা তখনকার, লোডশেডিংয়ের রাতে
মাদ্রাসার মাঠ জুড়ে তারাদের সার্কাস হত

(২)

এ শহরে পয়লায় শুধু গ্রীষ্মের ক্যালেন্ডার বিক্রি হয়

অমলতাসের বেলা। ঝুলি ভরে এসেছে আমারও
বিকেল ফুরোতে এত দেরি হল বলেই তো
পিচরাস্তা বেয়ে নেমে পড়া গ্যালো । চা-গুমটি আলোয় সাজাতে
কোন সুদূরের থেকে ঝুঁকে আছে কৃষ্ণচূড়ারা
বাঁয়ে ' মা অন্নপূর্ণা ভান্ডার'- দুদন্ড বসার ঠিকানা
এসে দেখি আমিই প্রথম । ধার-বাকি লেখা সেই ছোট্ট খাতাটি
এখন আমার হাতে । গাঁদাফুলে মোড়া চারিধার
আমার কি দোকানি-কে ঝুলি খানি দেখানো উচিত
এই ভাবনার মাঝে কে যেন রুক্ষ মুখে শরবত নামিয়ে গেলেন

মেঘ-বৃষ্টির কথা ছিল না কোথাও। অথচ কীসের তাড়া
ভুল,যথেচ্ছ ভুল এক ঢোঁকে গিলে ফের রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম


বৈশাখের কবিতা ৪


মৃত্যুভক্ষ্য রক্তিম আপেল  ...
                                -প্রদীপ চক্রবর্তী

এক /

পুরোনো অথবা পুরোনো নয়
স্বল্প পাখির দূর দিকচক্র | ততটা ক্ষিপ্র নয় দেহাতি ফকিরচাঁদ , করুণ ভাঁটির গঞ্জে |
যেন কুহকের জন্ম দেবে শহরের পথ ,
আসমানি রঙ ধুয়ে বৃষ্টির গোলকধাঁধা |
ঈষৎ সর্বস্বে সে - ই ফিরিয়ে আনে
অখিল যৌনভবনকে গর্ভ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে | হয়তো ভুল করেই গায়ে বসালো মধ্যস্থতাকারী প্রজাপতি |

পুরোনো ভাঙন অথবা পুরোনো নয়
নৈঃশব্দ্য - শৈলী বয়ে তোমার অবিকল
কলঙ্কভোগের রাসস্থ মন্ডল

কে পুরোনো ? কেনই বা সংশয় এই শব্দের
স্নায়ু  - কাঠ কুঁদে রচনা কাল ! তাদের কুঞ্জ নেই
প্রজাপতি নেই ,
পুরোনো প্রবাদের মতো প্রেমের দু - একটা বিকল্প হাইকু | নেই একটা আবর্ত | ক্ষুরধার রাস্তাটি কেবল জিভ দিয়ে চাটে ভুবনমনমোহিনী
স্নায়ুর বহুযুগ অপসারিত অধরা |
নদীর নতুন অশোকস্তম্ভ | সরল তরল আঁধার আলোর ছানারা , দূরে খেলাঘর দূরবাসের জলে দোল খাচ্ছে ফকিরা | হয়তো ভুল করেই গায়ে বসলো পৃথিবী নামক বাড়ি | পৃথিবী নামক চন্দ্রবিন্দু ...


দুই /

তুমি অথবা কারুকাঠ | দুজনের সৌন্দর্য্য মধ্যবয়সের এক পুরুষ | বিনির্মাণের রাস্তায় দাঁড়াও | একাকী দাহ্য কান্নাকুসুম | দশচক্রের
দেশগাঁয়ে পঞ্চমবর্জিত ধৈবতে বাজে এতো বৃষ্টির নীল তাঁত |

তার মসৃণ কলা , অমসৃণ রঙ ফুরাবে এতো স্বল্পবাসা কিশোরীর ঘুম - ফ্রকের বোতাম খোলা স্তনে | আতপ্তকাঞ্চনরঙা পৃথিবীর পারদ ও জল ভাসছে | শ্রমে ও মেধায় পৃথিবীর শেষ অতসী গাছের চেয়ে কিছু বড়ো নদী | অতিকায় ঘোড়াদের স্বতোৎসারিত ক্রম রেশমি কেশর থেকে কয়েকফোঁটা মুক্তো নিষিক্ত করে | সিক্ত সেলাই শেষে প্রান্তবাসিনীর নৈর্ব্যক্তিক আঁচল উড়িয়ে উন্মত্ত ঢেউ দুটো নিয়ে থিতোয় জিরোয় জান্তব প্রত্নছায়ার মতো আদিম ভূগৰ্ভলীন
মানুষ | মুনলাইট গ্রোভে আকরিক পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে হারিয়ে যাই | চিহ্নহীন নখর দাঁত পিপাসা আর পুরুষাঙ্গ | তাদের স্বত্বাধিকারী আজো কেউ নেই | ব্যাঙের গা থেকে অল্প কিছুক্ষণ পাকের গন্ধ ভেসে আসে | মিলিয়ে যায় পৃথিবীর অনাবিষ্কৃত  প্রাথমিক তেলে ...

বৈশাখের কবিতা ৩


ফেমিনিস্ট
               -গৌরাঙ্গ মন্ডল


প্রতিটি ভালো লাগা স্ত্রীলোক ঘটমান
পুরুষ আয়ুটুকু, নাসিকাময়

একথা ভেবে নিও --- শরীর, ঘোড়া বলে
পেরোতে যাওয়া নেই মাটির ঘেরাটোপ


প্রিয় নখ উপড়ে ফেলার আগে
যতটুকু দুঃখ

পুরুষ পেল না

তেমন দৃশ্যের পর, মন্থন প্রেমিক, তুমি

আজীবন শূদ্র থেকে গেলে

বৈশাখের কবিতা ২


বাঁধনহারা
            -দেবারতি চক্রবর্তী


লেখার কিছু নেই
 
       সব ছিঁড়ে গেছে

যা বাঁধাই ছিল না

  সেসব
   
      ছিঁড়ে যাওয়ায়

দুঃখ পেতে নেই

বৈশাখের কবিতা ১

অ্যাসাইলাম
                 -পিয়ালী বসু ঘোষ 

যাবার আগে মায়ের সাথে একবার দেখা করতে এসেছি
এসে অবধি দেখছি কি যেন একটা গলদ
আমার মা আর আমার মা নেই

কেমন স্বার্থপর, পাখি হয়ে যেতে চাইছে
কখনো হলুদবসন্ত, কখনো মাঠচড়ুই
কখনো ঠা ঠা রোদ্দুরে আহ্লাদ খুঁজছে
কখনো আগুনে পুড়ে কড়াইয়ের রঙে মিশে যাচ্ছে
হয়ে যাচ্ছে লেজঝোলা ফিঙে

আমি বোকা সন্তান মাকে খুঁজছি
কিছুতেই পাচ্ছিনা
রাগছি,কামড়াচ্ছি, উপড়ে ফেলছি শরীর গজিয়ে ওঠা ঘন বন

ওইতো,
মা ঘাসের পালকিতে এদিকেই আসছে এবার
আমি প্রস্তুতি নিয়েছি
পরিচয় দেব 'মা,আমি তোমার প্রথম সন্তান'

কিন্তু, জাপটে ধরতে গেলেই
মা একবার আকাশ, একবার ডানা হয়ে যাচ্ছে
পাখি হতে পারছেনা
কেবল বেহারা বিহীন পালকিটা শূন্যে ভাসছে