Friday, 22 September 2017

আশ্চর্য্য ধারাবাহিকঃ হারিয়ে যাওয়া নব্বই- দ্বিতীয় পর্ব

Image result for pradip abstract painting


                      প্রদীপজন্মের আলো
                                  -অনিন্দ্য রায়

২০০৬ বর্ধমান থেকে ফিরছি। এক বন্ধু অপেক্ষা করছে দুর্গাপুর স্টেশনে। তার মোটরবাইকে। আমরা দুজন গন্তব্য বেলিয়াতোড়। তারপর দুজনেই যাব আরেকটু পথ, সে যাওয়া আলাদা বেলিয়স্তোড়ে সুদীপ, স্বরূপ অপেক্ষায়। ওদের সাথে খানিক কবিতাসময়ের পরিকল্পনা।
আমাদের গল্পে বাইক এগোয়, পথের পাশে অপার ধানক্ষেতের মাঝে কারখানা,  চিমনি থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখে, চকিতে ‘ নিসর্গফ্যাক্টরি থেকে ধোঁয়া উড়ছে আকাশকেতনে’ এরম কথা আসে মনে, দুজনেরই। বাইক বাতাস সরিয়ে এগোয় কিছুটা; তারপর গতি কমে আসে। সে বলে ওঠে,’ এই রে! তেল শেষ, রিজার্ভে ছিল’ ।
 পথ ঢালু, সে গিয়ার নিউট্রাল করে, বন্ধুত্বে যেরম হয়, ততটাই নিউট্রাল। নিজের মোমেন্টামে বাইক  গড়াতে থেকে, যেরম বন্ধুত্ব নিজেরই স্বভাবে গড়িয়ে যায়।
 থামে। হ্যাঁ, একসময় যখন বাইক থামে, দেখি, পেট্রলপাম্প ওই তো, আর মিটার দুশো  
একটা ফুয়েল ফুরিয়ে যাওয়া যান আমদের এতদূর নিয়ে এসেছে।
বন্ধুত্ব এরমই তো পারে। এরমই তো নব্বই। নব্বইয়ের বন্ধুত্ব  নিয়ে যায় ততদূর যেখানে আবার জ্বালানি ভরে নেওয়া যায়, নিয়ে যায় আমাদের ।
আমি আর প্রদীপ হালদার।
 একই সময়ে লেখালেখি শুরু করি । মাঝেমধ্যে দেখা হয়, বইমেলায়, কবিতার অনুষ্ঠানেকথা হয় অল্প।  আলাপ যেটুকু কবিতায়,  বন্ধুত্বও। পরে আমি যখন বর্ধমানে, ও দুর্গাপুরে, একদিন বর্ধমান ইউনিভার্সিটির এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরি। ক্রমে সে আলিঙ্গন নিবিড় হয়। ফোনে সে আমার নাম্বারটিকে  বেছে নেয় মিনিমাম কলচার্জের জন্য। তার সুযোগ ছিল এরম দুটি নাম্বার সিলেক্ট করার। তো, সে একটি বাড়ির আর অবশিষ্ট একটি মাত্র শূন্যস্থানে আমাকে রাখে। আমাদের দিন কাটে কথায়, কবিতায়, তর্কে, উল্লাসে। 
 সেই প্রদীপ, শান্ত, দীপ্ত, মৃদুভাষী। এখন আর লেখে না। কবিতা এখন তার লেন্সে। শব্দ, বাংলা অক্ষর  থেকে সে দূরে।
 এই দূরত্ব থেকেই আমি পড়ি তার কবিতার বই।
 ‘প্রানিজন্ম’, তার প্রথম কবিতার বই। এক ফর্মা। ১২টি কবিতা। রচনাকালঃ ১৯৯০-১৯৯৪। প্রকাশকঃ কবিতা দশদিনে।, মুল্যঃ ৫টাকা; বইমেলার মুল্যঃ ২ টাকাপ্রচ্ছদে একটি বায়সের ছবি, না, খণ্ডচিত্র,  কালো, সঞ্জয় রক্ষিত কৃত।  প্রকাশকালের কোনো উল্লেখ নেই।
 একই সাথে সেবছর অংশুমান আর প্রদীপ করের এক ফর্মার কবিতার বই বেরিয়েছিল ‘কবিতা দশদিনে’ থেকে, মনে আছে। 
 প্রাণিজন্ম, বইটি আমি হাতে পাই  প্রকাশের কিছুদিন পর। একেকটি কবিতা প্রদীপের সাথে বোঝাপড়া  আরও দৃঢ় করে।
                             ঋতুবোধ ছিল না বলে বিরহী বিছানা
                             বর্ষায় ছাতা-বুকে একাকী কুমনা
                             সুতরাং গয়ংগচ্ছ, একা একা জলে
                             আঁক কষি দুর্মনে জ্যাট্রিন-দেয়ালে
                             পাশবাড়ি হাসে যেন ঘোর ও প্রদাহে
                             আমি শুধু ভেবে যাই সম্পর্ক বিষয়ে

                             জল পড়ে পাতা নড়ে কাকগুলি ডাকে
                             কলঘরে মনে পড়ে তাকে ও তোমাকে
                             ছয়দিন বাসে ত্রেণে সাড়ে সাত-চার
                             রবিবার প্রাণিজন্ম খোঁচায় অন্ধকার
                                                          ( প্রাণিজন্ম )
নিজস্ব প্রকাশভঙ্গীর খোঁজ তার প্রথম থেকেই। সে এক সময়, আমাদের বেঁচে থাকার সর্বস্ব তখন কবিতা। জাগরণ পেরিয়ে, ঘুম পেরিয়ে, স্বপ্ন পেরিয়ে, বাস্তবতা পেরিয়ে অন্য এক চেতনস্তরে প্রদীপ তখন জ্বলছে।
                             প্রেমকে ওপরে, দশতলায় তুলে দিয়ে
                             স্বপ্ন ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে
                             স্বপ্ন ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে
                             নিচে নেমে এলাম, একাকী নিচে

                             তারপর হঠাৎই অপ্রতিভের মত ঘাড় ঘুরিয়ে
                             বলে উঠলাম ঃ শুভরাত্রি
                             আর এই শব্দে হোটেলের সমস্ত দরোজা
                             একে একে বন্ধ হয়ে গেল .....

                             চার দেওয়েলের ভেতর আলোর সাঁতার বিষয়ে
                             ভাবতে ভাবতে অসম্ভব আলোহীনতায়
                             আকাশে তাকিয়ে দেখলাম ঃ একটিও তারা নেই
                             ঘটনা এই ঃ সেই রাত্রে শহরের সমস্ত ল্যাম্পপোস্ট
                             ট্রাফিক পুলিশের মত ঘুষ চেয়েছিল ।
                                      (ট্রাফিক পুলিশের মত ল্যাম্পপোস্ট )
সে কারিগরী শিক্ষা নেয়, কর্মরত দুর্গাপুর স্টিলপ্ল্যান্টে। ছবি তোলে। কবিতা লেখে না। রক্ষণের কোনো অন্য প্রকরণ সে হয়তো আয়ত্ত করেছে।
                             জীবনযাপন থেকে উঠে আসে অ্যান্টিসেপ্‌টিক ক্রীম
                             ক্ষুধায় অবনত দেবদারু গাছে বাতাস লাগে না
                             ত্বকচর্চাই ডিফেন্সের সহজ উপায় ।
                                                                      ( দিনচর্চা / ১)
এই উচ্চারণ নব্বইয়ের সম্মিলিত কবিতাযাপন আর ব্যক্তিগত ভাষাশৈলীর উদাহরণ। খুবই পার্সোনাল কথা কীভাবে কবিতা হতে পারে, পাঠকেরও আপন হতে পারে, রহস্যময় হয়েও কমিউনিকেটিভ হয়ে উঠতে পারে - প্রদীপের কবিতা তা প্রমাণ করে।
                             অপরূপ রূপে রাত আসে আজকাল
                             বিছানা গম্ভীর, মানিব্যাগ পড়ে থাকে অবচেতনভাবে
                             কাকে কি বলব বল? হাতের রেখার পথে
                             ছারপোকা হেঁটে যায় ।

                             গ্র্যান্ডিং মেশিন থেকে ছিটকে আসে স্বপ্নের বাবড়ি
                             কতটুকু মসৃণ হল জীবন ? ঘর্ষণে
                             টের পাই বস্তুগোলক।

                           দুষণ দুষণ আহা উপত্বক পুরু হয় বিপ্রতীপভাবে
                             অশোধিত সূর্যালোকে ঝলসে ওঠে
                             লোহার বাজার ।
                                      (গ্র্যান্ডিং মেশিন ও স্বপ্নের বাবড়ি সমূহ )
 বিজ্ঞানের অনুষঙ্গ সে নিয়ে এসেছে কবিতায়। এনেছে শরীরের কথা, শারীরিক সুখ ও অসুখের কথা। তার পরের বই ‘ মাংসবিলাসিনী’ ।
 কিন্তু তারপর?
 লেখে না সে। সত্যিই কি লেখে না?
 প্রদীপ, আমরা যে শকটে চলেছি তা তো ততদূর নিয়ে যাবে আমাদের যেখানে আবার পরের পথের জন্য রসদ ভরে নিতে পারব। সে রসদ কবিতার।
 আর বাইক, তা তো বন্ধুত্বের।
 জানি, একদিন আমার ফোন বেজে উঠবে, তোমার গলা, ‘ অনিন্দ্য, নতুন কবিতা লিখেছি, শুনবে?”
 আমার তো সেই ফোননাম্বারই আছে, তুমি অ্যাসাইন করেছিলে তোমার দুই নিকটজনের একটি হিসেবে। 
 কতদিন ফোন করোনি ।   তোমার ‘স্বপ্ন সন্ত্রাসকালীন রিপোর্ট’ জানা হয়নি আমার।
ভালো আছ ?
             

                 ( উদ্ধৃত কবিতাগুলির বানান ও যতিচিহ্ন মূল বইটির অনুসারী ) 

(ছবিঃ প্রদীপ রাউত) 


No comments:

Post a Comment