“লোকাল ট্রেনগুলোতে রোদ ঢুকিয়ে পাঠানো হয় মফঃস্বলে”
-অনিন্দ্য রায়
হারানো বন্ধুকে নিয়ে সবকথা একবারে বলা যায় না, হয়ত কখনোই যায় না, তাই আবার প্রলয় ।
“ গোটা শহর জুড়ে এখন বিকেলের রোদ
মুখ পুড়বে না জেনেও একদল যুবতী
ভিক্টোরিয়া বাতিল করে
ছাদে তখন রোদের বন্যা
গাড়িগুলো হুড খুলে নিতে ব্যস্ত হয়
‘এত রোদ আসে কোত্থেকে’
লোকাল ট্রেনগুলোতে রোদ ঢুকিয়ে পাঠানো
হয় মফঃস্বলে
যুবতীর দল স্বস্তি পায়
ভিক্টোরিয়া হয়ে ওঠে আলো ঝলমলে
কিন্তু বিকেল আর বিকেল থাকে না”
( সন্ধে হবার আগে )
মফস্বলের রোদ ছিল প্রলয়, তীব্র, সফিস্টিফিকেশনের চোখে জ্বালা ধরিয়ে দেওয়া উজ্জ্বল রোদ । আসুন, আমরা তার আরও কবিতা পড়ি,
“ এখানেই থেমে থাকা নয়
অথবা নিওন বৃষ্টি এবং কান্নাজলের শেষের
নাম অযান্ত্রিক এগিয়ে যাওয়া ......... রুকাবট
বায়ুতল থেকে বেরুতে থাকা হাসপাতালধর্মী
তুলোগন্ধ ও থেমে যাওয়া হৃৎযন্ত্রের
আবেশ হারিয়ে যায় দাঁড়িয়ে থাকা লিফটে ।
কমরেডঃ আসুন এবার আমরা সমস্ত থেমে থাকার
বিরুদ্ধে যৌথ সংগ্রামের মকসো করি ।”
( বিনোদন )
‘থেমে যাওয়া হৃৎযন্ত্রের’ পরেও থেকে যায় আরও কিছু, থেকে যায় স্মৃতি।
রয়ে যায় কবিতা ।
“ ঝরে যাবো একান্ত আনুগত্যে তারপর সারা
শহর জুড়ে শুধু লাট্টুওলার দুর্ভোগসংক্রান্ত যাপনচিত্র
অতএব দড়িহীন অবস্থায় ঘুরতে হবে তোমাদের
আর হিপোক্রিট ভিখারিসম্রাটের পুরনো কৌটোয়
বন্দি থাকবে দুষ্টুমি ও ডলারব্যয়ের আপাতকথা
এভাবেই ঝরতে ঝরতে তৈরি ফাঁদে আমাদের
কাছে এসে পড়বে হাজার বছর আগেকার
ব্যাঙ দম্পতির উন্নত হৃৎপিণ্ডযুক্ত ফসিল
অথবা টানটান শুয়ে পড়া ক্যালসিয়াম থেকে
ইট খসে পড়বে ভদ্র মস্তিষ্কের উল্টোদিকে
এখানে চিহ্নিত হোক দিক্ দর্শন পাপড়ি মুক্তি
কিম্বা গোল্ডেন হ্যান্ডশেক থেকে মাত্র পনের
বছর দূরে দাঁড়িয়ে আছে চল্লিশ শেষের ভদ্র বাসস্থান
লাট্টুওলার বাক্প্রতিরোধে অগ্রাহ্য করে শহরের
মধ্যিখানে বিছিয়ে পড়ব সুতোসমেত”
( পনের বছর পর )
পরবর্তীতে প্রলয়ের আরেকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কথা ছিল, ‘ আজ থেকে যন্ত্রণাদের বিরতিসব’। তা হয়েছে কিনা জানি না। কিন্তু সমস্ত যন্ত্রণায় পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়ে সে, কবি প্রলয় মুখোপাধ্যায়, আমার বন্ধু পাড়ি দিয়েছে না-ফেরার দেশে।
তার কবিতার একটি বই ছাড়া আর কিছু নেই আমার কাছে, স্মৃতি ছাড়া আর কোনো মনখারাপ নেই ।
“মায়ার খোঁজে প্রায়দিনই তিনজনে ক্যামেলিয়া
প্রতিদিনই বেড়ে যাওয়া রাস্তাপ্রান্তে উঁচু পানঘর
কোনোদিনই তিনি আসেন না
আময়া তাঁর উপস্থিতির সম্ভাব্য সমস্তরকম
কৌশলে ব্যর্থ হলে প্যাকেটে ঊষা
ঝরে যাওয়া যায় একলহমায়
আপত্তিকালীন দিনগুলোর মায়া এখনো
লেগে থাকে প্রতিটি টিপ বোতামের ফাঁকে ফাঁকে
আর পরিচিত আতরগন্ধ
এভাবেই চরম প্রাপ্তি
ক্যামেলিয়া ঝলমল করে তিনি
আসেন ভুলে যাওয়া হয় গ্লাসভাঙা
সংক্রান্ত বিশেষ বিপদ ব্যথা অথবা
পুরনো ক্যলেন্ডারের নিচে পুরনো রেট
তিনি আসেন ফুরফুরে হিম ছড়ানো
কার্পেট আর সাদাটে দেওয়ালের আড়ালে
পরিচিত সানমাইকা ঘরে
মায়াময় তিনটি উত্তাপ বেড়ে যাওয়া
সাইকেলের গ্লাস খালি হলে
অপেক্ষা পরবর্তী আর একটি সন্ধেবেলার”
( সুস্মিতা সান্যাল অথবা চরম অন্তর্বতী বিক্ষোভ )
অথচ আমাদের আর কোনো অপেক্ষা নেই।
...
নব্বই এরকমই ।
কত তরুণ লিখতে এসেছে, বাংলা কবিতা লিখতে এসেছে! লিখেছে, নিজের জীবন দিয়ে, কবিতায় দাহ করেছে নিজেকে ।
তাদের বাদ দিয়ে বাংলা কবিতা সম্পূর্ণ হয় না। লোকাল ট্রেনগুলোতে যে রোদ ঢুকিয়ে পাঠানো হয়, যে রোদ ছড়িয়ে পড়ে তার সংশ্লেষই তো বাংলা কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখে ।
( ছবিঃ গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর )
No comments:
Post a Comment