Friday, 5 January 2018

আশ্চর্য্য ধারাবাহিকঃ হারিয়ে যাওয়া নব্বই- পর্ব ৬

Related image

‘আমার বন্ধুরা আমারই চারপাশে মাটির জল শুষে বেড়ে উঠছে’
রামাশিস অধিকারীর কবিতা 
-অনিন্দ্য রায়

নব্বইয়ের শুরুতে পুরুলিয়ায় আমারই বয়সী কয়েকজন কবিতা নিয়ে একত্রিত হচ্ছিল এবং আদের অভিভাবক ছিলেন সেই শহরের অগ্রজেরা । ‘ছাতিমতলা’ পত্রিকাকে ঘিরে তাদের আড্ডা, তাদের বেড়ে ওঠা । তারা অচিরেই আমার বন্ধু হয়ে ওঠে, কবিতার বন্ধু, যদিও মুখোমুখি দেখা যে সবার সঙ্গে হয়েছে এমন না। কিন্তু বন্ধুত্ব, হ্যাঁ, পরস্পরের লেখা পড়ার, সে লেখা নিয়ে ভাবার, একই পত্রিকায় লেখার বন্ধুত্ব, যেরকম হত আরকি সেই নব্বইয়ে।
রামাশিস সেরকমই বন্ধু আমার ।
রামাশিস অধিকারী । তার কবিতায় এক সহজযাপন, সরাসরি মানুষের কথা, মানুষদের কথা, পুরুলিয়া ও তার জলবায়ু উচ্চারিত হত।
অন্ধকারে জন্ম
অন্ধকারেই আমাদের বেড়ে ওঠা

অতীত হারিয়ে গেছে অন্ধ গুহায়
অন্ধকারে কোন্‌ সে আগামী

তবু
আমাদের হাত
কেবলই আগুন ছুঁতে চায়
( এই জন্ম )
এই কবিতা দিয়ে শুরু তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ, ‘এই জন্ম’। প্রকাশকালঃ জানুয়ারি, ১৯৯৯। প্রকাশকঃ ছাতিমতলার পক্ষে কিশোরকান্তি দাশ। প্রচ্ছদঃ প্রদীপ সিংহ। বিনিময়ঃ পাঁচ টাকা।
১৬ পৃষ্ঠার বই, মোট ১২টি কবিতা।
উৎসর্গঃ মা ও বাবিকে।
মা এই ভাবনাটি রামাশিসের কবিতায় আমরা সেখি দারিদ্রের পটভূমিকায় । ভূপ্রকৃতিগতভাবে পুরুলিয়া জেলায় যেটুকু বৃষ্টিপাত হয় তা নদী বেয়ে অন্য জেলায় বয়ে আসে। আর সেই জেলা নিজে রয়ে যায় রুক্ষ, সে জেলার সন্তানেরা পিপাসার্ত। রামাশিস লেখে
অন্যের হেঁসেলে ভাত ফোটাতে ফোটাতে
তুমি ভাবো
তোমার ঘরে ভাত ফোটেনি কতদিন
তোমার ছেলেটা কখন একা একা
ধুলোমাটি নিয়ে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে
তখন তুমি কাকে কোলে নিয়ে
মুখে তুলে দাও দুধের বাটি

তোমার হাত কি কাঁপে মা
বুক কি ভেঙে আসে কান্নায়
( মা )
এই অভাবের মধ্যেই, অস্বচ্ছলতার মধ্যেই বেঁচে থাকার লড়াই, বড়ো হওয়ার লড়াই। এই লড়াই পুরুলিয়ার মাটিতে যে কোনো সৃজনে মেতে থাকা যেকোনো মানুষের চূড়ান্ত সংগ্রাম । মহানগরের ক্লেদ, চাতুর্য, সম্পত্তির ব্যক্তিমানিকানা নিয়ে বিভেদ ও সংঘাত থেকে কিছু সাধাসিধে মানুষের নিষ্কলুষ বেড়ে ওঠা, কোনো কিছুকে দখল করতে নয়, আগ্রাসন নয়, বড়ো হওয়া ।
কোনদিন আকাশ দেখে মনে হয়নি
আকাশটা আমাদের
আকাশ দেখে ভয় হয়, হয়ত হারিয়ে যাব
খুঁজে পাব না আমাদের পথ

তারাদের দেখেও মনে হয়নি আমার বন্ধু
আমার বন্ধুরা আমারই চারপাশে
মাটির জল শুষে বেড়ে উঠছে

তবু ;
তারা ও আকাশের দিকে
আমাদের প্রতিদিন বেড়ে ওঠা
                        ( বৃক্ষবাসনা )
এই বাসনা নিয়েই তো তার আশেপাশের মানুষজন, তার বন্ধুরা, ‘ চারপাশে মাটির জল শুষে বেড়ে উঠছে’। তাদের নিয়েই তো রামাশিসের বেঁচে থাকা, রামাশিসের কবিতা। সে কবিতা ভনিতাহীন, সে কবিতা নাগরিক অনুকরণ নয়, মোহিনী আড়াল নয়, জীবন, তরতাজা জীবন, আগুনে সেঁকে নেওয়া প্রাণ ।

খেলনা গাড়ী, ব্যাট-বল ওদের জন্য নয়
চারপাশে প’ড়ে থাকা নোংরা কাগজ আর
টায়ারের টুকরো জড়ো করে
ওরা আগুন জ্বালে ।

আগুন ফনা তোলে
আগুন নেচে নেচে ওঠে ।
(শৈশব )

রাত্রি বাড়ার সাথে সাথে
ফুটপাতেও দৃশ্য বদল হয়
সারা দিনের ব্যস্ত বাণিজ্য শেষে
ফুটপাত হয়ে ওঠে  এক একটা রান্নাঘর

ভাত ফোটে

শুকনো ডাল পালার সাথে তাদের
কালো রোগা হাত পা গুলোও যেন
সেঁধিয়ে যায় আগুনের ভেতর

ভাত ফোটে
           ( জীবন )
এই জীবনের সাথেই ত আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সে, রামাশিস, আমার বন্ধু ।
আমার সাথে তার প্রথম দেখা ২০০৮-এ । নিজের লেখার মতোই সে অকপট, মুখোশহীন, মানবিক।
একটু কথা বলেই তাকে ভালো লেগে যায়। যেমন একদিন ভালো লেগেছিল তার কবিতা ।
লেখে কি এখন ? নিশ্চয়ই লেখে।
এই বইটিতে ১৯৯৪ অব্দি লেখা আছে তার। সে ও তার ছাতিমতলার বন্ধুরা বাংলা কবিতায় এক অন্য ভাষ্য তৈরি করেছে। প্রন্তিক মানুষের কবিতাভাষ্য । রামাশিস যদি না লেখে সেই মানুষগুলির কথা আর কে লিখবে? সেই মাটির কথা আর কে পরম মমত্বে তুলে ধরবে আমাদের সামনে।
আমি অপেক্ষায় রামাশিসের আরও আরও কবিতা পড়ার, এই সময়ের আরও আরও রামাশিসের কবিতা পড়ার।
বন্ধু ।

(ছবিঃ ভাসিলি ক্যান্ডিনস্কি) 

No comments:

Post a Comment