Thursday, 12 April 2018

মধুমাসের আশ্চর্য ধারাবাহিকঃ হারিয়ে যাওয়া নব্বইঃ পর্ব ৯

Related image


“লোকাল ট্রেনগুলোতে রোদ ঢুকিয়ে পাঠানো হয় মফঃস্বলে”
-অনিন্দ্য রায়


হারানো বন্ধুকে নিয়ে সবকথা একবারে বলা যায় না, হয়ত কখনোই যায় না, তাই আবার প্রলয় ।
“ গোটা শহর জুড়ে এখন বিকেলের রোদ
  মুখ পুড়বে না জেনেও একদল যুবতী
  ভিক্‌টোরিয়া বাতিল করে
  ছাদে তখন রোদের বন্যা
গাড়িগুলো হুড খুলে নিতে ব্যস্ত হয়
‘এত রোদ আসে কোত্থেকে’
লোকাল ট্রেনগুলোতে রোদ ঢুকিয়ে পাঠানো
 হয় মফঃস্বলে
 যুবতীর দল স্বস্তি পায়
 ভিক্‌টোরিয়া হয়ে ওঠে আলো ঝলমলে
 কিন্তু বিকেল আর বিকেল থাকে না”
( সন্ধে হবার আগে )
মফস্বলের রোদ ছিল প্রলয়, তীব্র, সফিস্টিফিকেশনের চোখে জ্বালা ধরিয়ে দেওয়া উজ্জ্বল রোদ । আসুন, আমরা তার আরও কবিতা পড়ি,
“ এখানেই থেমে থাকা নয়
  অথবা নিওন বৃষ্টি এবং কান্নাজলের শেষের
  নাম অযান্ত্রিক এগিয়ে যাওয়া ......... রুকাবট

  বায়ুতল থেকে বেরুতে থাকা হাসপাতালধর্মী
তুলোগন্ধ ও থেমে যাওয়া হৃৎযন্ত্রের
আবেশ হারিয়ে যায় দাঁড়িয়ে থাকা লিফটে ।
কমরেডঃ আসুন এবার আমরা সমস্ত থেমে থাকার
বিরুদ্ধে যৌথ সংগ্রামের মকসো করি ।”
( বিনোদন )
‘থেমে যাওয়া হৃৎযন্ত্রের’ পরেও থেকে যায় আরও কিছু, থেকে যায় স্মৃতি।
রয়ে যায় কবিতা ।
“ ঝরে যাবো একান্ত  আনুগত্যে তারপর সারা
শহর জুড়ে শুধু লাট্টুওলার দুর্ভোগসংক্রান্ত যাপনচিত্র

অতএব দড়িহীন অবস্থায় ঘুরতে হবে তোমাদের
আর হিপোক্রিট ভিখারিসম্রাটের পুরনো কৌটোয়
বন্দি থাকবে দুষ্টুমি ও ডলারব্যয়ের আপাতকথা

এভাবেই ঝরতে ঝরতে তৈরি ফাঁদে  আমাদের
কাছে এসে পড়বে হাজার বছর আগেকার
ব্যাঙ দম্পতির উন্নত হৃৎপিণ্ডযুক্ত ফসিল
অথবা টানটান শুয়ে পড়া ক্যালসিয়াম থেকে
ইট খসে পড়বে ভদ্র মস্তিষ্কের উল্টোদিকে

এখানে চিহ্নিত হোক দিক্‌ দর্শন পাপড়ি মুক্তি
কিম্বা গোল্ডেন হ্যান্ডশেক থেকে মাত্র পনের
বছর দূরে দাঁড়িয়ে আছে চল্লিশ শেষের ভদ্র বাসস্থান
লাট্টুওলার বাক্‌প্রতিরোধে অগ্রাহ্য করে শহরের
মধ্যিখানে বিছিয়ে পড়ব সুতোসমেত”
( পনের বছর পর )
পরবর্তীতে প্রলয়ের আরেকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কথা ছিল, ‘ আজ থেকে যন্ত্রণাদের বিরতিসব’। তা হয়েছে কিনা জানি না। কিন্তু সমস্ত যন্ত্রণায় পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়ে সে, কবি প্রলয় মুখোপাধ্যায়, আমার বন্ধু পাড়ি দিয়েছে না-ফেরার দেশে।
 তার কবিতার একটি বই ছাড়া আর কিছু নেই আমার কাছে, স্মৃতি ছাড়া আর কোনো মনখারাপ নেই ।
“মায়ার খোঁজে প্রায়দিনই তিনজনে ক্যামেলিয়া
প্রতিদিনই বেড়ে যাওয়া রাস্তাপ্রান্তে উঁচু পানঘর
কোনোদিনই তিনি আসেন না
আময়া তাঁর উপস্থিতির সম্ভাব্য সমস্তরকম
কৌশলে ব্যর্থ হলে প্যাকেটে ঊষা
ঝরে যাওয়া যায় একলহমায়
আপত্তিকালীন দিনগুলোর মায়া এখনো
লেগে থাকে প্রতিটি টিপ বোতামের ফাঁকে ফাঁকে
আর পরিচিত আতরগন্ধ
এভাবেই চরম প্রাপ্তি
ক্যামেলিয়া ঝলমল করে তিনি
আসেন ভুলে যাওয়া হয় গ্লাসভাঙা
সংক্রান্ত বিশেষ বিপদ ব্যথা অথবা
পুরনো ক্যলেন্ডারের নিচে পুরনো রেট
তিনি আসেন ফুরফুরে হিম ছড়ানো
কার্পেট আর সাদাটে দেওয়ালের আড়ালে
পরিচিত সানমাইকা ঘরে
মায়াময় তিনটি উত্তাপ বেড়ে যাওয়া
সাইকেলের গ্লাস খালি হলে
অপেক্ষা পরবর্তী আর একটি সন্ধেবেলার”
( সুস্মিতা সান্যাল অথবা চরম অন্তর্বতী বিক্ষোভ )
অথচ আমাদের আর কোনো অপেক্ষা নেই।
...
নব্বই এরকমই ।
কত তরুণ লিখতে এসেছে, বাংলা কবিতা লিখতে এসেছে! লিখেছে, নিজের জীবন দিয়ে, কবিতায় দাহ করেছে নিজেকে ।
তাদের বাদ দিয়ে বাংলা কবিতা সম্পূর্ণ হয় না। লোকাল ট্রেনগুলোতে যে রোদ ঢুকিয়ে পাঠানো হয়, যে রোদ ছড়িয়ে পড়ে তার সংশ্লেষই তো বাংলা কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখে ।



( ছবিঃ গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর )

মধুমাসের কবিতা ১৯

Image result for abstract painting famous artist

চিত্রপট
      -সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য্য

সবটাই প্রহসন।
জীবনযুদ্ধ, ভালোবাসা, চাওয়া-পাওয়া---সবটাই কেমন হাস্যকর নাটকের মঞ্চের মতো;আর আমরা সবাই সেই নাটকের ক্লাউন চরিত্র।

বুকে কষ্ট তাও হাসো,প্রেম নামক শব্দটি শত হস্ত দূরে তাও বাঁধভাঙা ভালোবাসার অকারণ উচ্ছ্বাস... আদিখ্যেতা নয় কি?

দু'আঙুলে পেন্সিল ধরে বৃত্ত আঁকার ব্যর্থ প্রয়াস,
তবু শিল্পীর তকমাটি চাইই।
যুক্তিহীন কালি-কলম চর্চায় কিটস্ মাটিতে গড়াগড়ি যায়, বাংলা কাব্যের উচ্চারণে একঘরে হওয়ার আশঙ্কা, মস্ত কবির শিরোপা যেন হাতছাড়া না হয়...

সর্বত্র জুড়ে শুধু চাওয়ার মিছিল।
ভগ্নাংশ ভুলে গেছে জীবন, টুকরো সুখ জুড়ে ভালোবাসার সাঁকো আজ কেউ বাঁধে না।
রোজ নিঃশ্বাস বদলায় চাদরের রঙে...

( ছবিঃ গ্রেগরিয়া ও'কীফ )

মধুমাসের কবিতা ১৮

Image result for abstract painting famous artist



শূন্য আঁকি,  মৃত্যু আঁকি
                          -পাপড়ি গুহ নিয়োগী




মৃত্যুকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করিয়ে

বুক থেকে জমজ স্তন

মসৃণ পেট থেকে সুগভির নাভি

পর্দার ঘোমটা সরিয়ে নিতম্ব

ভেতর জলে সাতাঁর কেটে কেটে চুপকথারা

মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে, স্নান করিয়ে দেয় চন্দনজলে

তারপর শব ঘিরে, উল্লাস উৎসব

মদ-মাংসের সাথে মুখাগ্নি করে সময়

রাজা আসে যায়, আসে না সুদিন



 ৮

গন্তব্য আঁকতে আঁকতে

আত্মহত্যা এঁকে ফেলেছি

রাংতায় মোড়া জোলাম এঁকেছি

কেউ একজন বলে

এই আঁকিবুকি ছেড়ে ঝুঁকি নাও সাহস করে

ঘরসংসার, ছেলেপুলে, কঠোর পরিশ্রম

 স্বচ্ছতা আঁকতে গিয়ে এসাইলাম এঁকে ফেলেছি

এখন একা ঘরে

শূন্য আঁকি,  মৃত্যু আঁকি



(ছবিঃ জোয়ান মিশেল ) 

মধুমাসের কবিতা ১৭

Related image

কিছু কিছু কথা
                  -পিয়াল রায়

১)

আমি মানিনা
আমি আসলে মানতে চাইনা
সেইসব হাত
যাদের থাবায় শ্বাসরোধ হয়

২)

এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে
টুপিটা খুঁজে বের করো
যার সাথে সাদৃশ্য আছে তোমার

কিন্তু তার আগে দেখে নিয়ো
টুপিটা তোমার মাথার মাপে কিনা

৩)

আজ তারা আসবেন
খবর পাঠিয়েছেন বৈদ্যুতিন চিঠিতে

আমিও প্রস্তুত

রোদ বৃষ্টির অমূলপ্রত্যক্ষ নিয়ে

৪)

আপনার জামার দুর্গন্ধ
ভারি করে তুলছে বাতাস

একটু সরে দাঁড়ান

অথবা

বদলে আসুন জামাটা

অথবা

জামাটা লুকিয়ে ফেলুন নিজের ভিতর

৫)

ভারতবর্ষকে পৃথিবীর
দুর্বলতম দেশের স্বীকৃতি দেওয়া হল

আবহাওয়ার খবর পড়তে পড়তে
লোকটা টুক করে জানিয়ে দিল
এ সংবাদ


৬)

এত রোদ চমকে এলো বিছানায়
চাদরটা নিয়ম ভেঙে
রোদের নিচে এলিয়ে দিল শরীর

কোনো জবাবদিহি না দিয়েই


৭)

বাসের পা দানিতে লাফিয়ে উঠে
মিলিয়ে গেল সে

যেন

মিলিয়ে গেল একরত্তি রোমাঞ্চ

ছন্নছাড়া বিকেলের


৮)

তুমি তাকে আনন্দে রাখো
যে তোমার আয়না থেকে মুছে দেয়
প্রতিদিনের ধুলোবালি

তুমি তার উপাসনা করো
যে তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে
প্রাচীন ব্যবচ্ছেদ থেকে

আর আমি আশ্চর্য বাগানের ভিতর
শুধু তোমাকেই খুঁজি

৯)

এই যে এত হৃদয়ের বাড়াবাড়ি
কাছাখোলা গড়িয়ে পড়ে
লালে-ঝোলে

তাদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা বলবো
আরো একটু সামলে ভায়া
নইলে যে পুরোটাই সেমসাইড হয়ে যায়

১০)

তিনি যখন উদিত হন
অস্তও এসে ঘিরে ধরে তাকে

তিনি যখন অস্তের দিকে যান
উদয়ও তখন সত্যের মতো থাকে

(ছবিঃ রব্বি লেইর্ড) 

মধুমাসের কবিতা ১৬

Image result for abstract by indian artist

নির্দয় মানুষের এলাকায় - ৩
                                   -জ্যোতির্ময় বিশ্বাস

যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা অঞ্চলে, একজন
মা’কে জিজ্ঞেস করা হলো― যদি
সন্তান ফিরে না আসে; সন্তানসম ভালো
কি আর কাউকে বাসবেন, বাকি জীবন?
মা চেয়ে থাকলেন শূন্যদিকে দীর্ঘক্ষণ
আর এ’কথা কে না জানে―
অপলক একটানা চেয়ে থাকলে
চোখে এমনিই জল আসে। দুঃখ লাগেনা।




(ছবি ঃ এলেনা মার্কিনা)

মধুমাসের কবিতা ১৫

Related image


পইঠা  
            -সুতপা চক্রবর্তী 


গৌতম বুদ্ধ এসে দাঁড়ালেন

সম্মুখে

এলিজির বারান্দায় মেদামারা কবুল
গোমসা তোলা রোমবিক্রিয়া
পুলক শিহরণ ত্বগংকুর
গৌতম বড়

বে
সু
রো

 প্রেমিক!
এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে

পেছনে

তখন আগুনগান পলাশগান
বুদ্ধং শরনং গচ্ছামি
জ্ঞানং শরনং গচ্ছামি
গৌতম একা নির্বাসনে
ওম শান্তি
ওম শান্তি
ওম শান্তি


(ছবিঃ অ্যালিস বেইলি)

মধুমাসের কবিতা ১৪

Image result for abstract universe painting by famous artist

শুধু তুমি নেই
       -শিবু মণ্ডল 

দখিন প্রান্তের দরজা খুলে থাকি কার জন্য আমি ??
শুনি কার প্রতিধ্বনি পথের ধূলায় মিশায়
জলে ভিজে রাস্তা এসে আমার দুয়ারে ঠেকেছে
                                                   আজ।
কান্না বাতাস দিশা ভুলেছে ঝড়ের বেগে
দুয়ার এঁটে বসে আছি আমি। খুলবে না খুলবে না
                                                   আর।
রামধনু সুর হারিয়েছে রাখাল বালক
লাঠির ঘা’য়ে ঘা’য়ে ঘাসের শীর্ষে শুধু ব্যাথা জাগে
                                                জাগে।

রাখাল বালক আছে শুধু রাখাল বাতাস আর নেই
রামধনু বাঁশি আছে শুধু রামধনু সুর আর নেই।

(ছবিঃ গ্রেগ সিম্পসন)

মধুমাসের কবিতা ১৩

Untitled.Meristem_2015_Pablo_Saborio_art

তিরিশ বসন্ত পেরিয়ে
                -জয়া গুহ (তিস্তা)

কেউ কারো হাত ছুঁতে পারিনি অথচ আমাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিরিশটা বসন্ত
আঙুলে আঙুল ছোঁয়ার আগেই নির্ধারিত হল বিচ্ছেদ
গাঢ় জমাট অক্ষরে মুক্তোর মত লেখা অভিশাপ"ভালোবাসা"
আমার রক্তাক্ত ক্ষত ঢাকে যেহাত
তাকে খুঁজে চলেছি এই তিরিশটা বসন্ত
বুটের আঁচড়ে খোলা ট্রেন লাইনের ধারে থেঁতলে ফেলা আব্রু
শিলাবৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে সাফ সেদিন
কনকনে ঠান্ডায় কুঁকড়ে ওঠা শরীরে মৃত্যুর পরিমাপ সাড়ে তিন হাত
মিনিটগুলোর সাথে পাল্লা দিতে দিতে তুমিও ক্লান্ত এখন
থিয়েটারে,বিচিত্রানুষ্ঠানে তুমি যাও পাশে কার ছায়া?
সেদিনের অন্তর্ধান নিয়মমাফিক নিরুদ্দেশের পাতায়
অন্তহীন উদ্বেগ পেরিয়ে চুলে পাক,চামড়ায় ভাঁজ
অথচ তোমার হাত দুটো আঢাকা,আজ-ও
বুকের মাপে চিবুক ছোঁয়ানো অহঙ্কার আমার একার
ওড়া চুল,উদ্ধত নারীত্ব পেরিয়ে যে কবিতাগুলো তুমি লিখতে চেয়েছিলে
তারা তরুণী চাঁদের মত ঘুমাতে শিখেছে বরফে-পাহাড়ে
তুমি যা কিছু হারাবে, তার সমস্তই আমি হারিয়েছি তিরিশ বসন্ত আগেই
তোমার হাতের বয়স তখন আঠেরো বিশ মতো
তোমার আঙুল আঁকতে শিখেছে,
কেমন করে সোহাগ করতে হয়,শিখেছে কি?
তুমি যা পার এবং পারোনি তার মধ্যে পেরিয়ে গেল তিরিশটা বসন্ত
আমার হাত, পায়ের আঙুল বলে কিছু নেই
অবয়ব বলে কিছু নেই
আমার থাকা আর না-থাকার মধ্যে কেটে গেল তিরিশটা বসন্ত
অনির্বাণ! পাঁচ উপত্যকার আগুন একা পোহাতে পোহাতে
রেললাইনের লোহার ভাঁজে শেষ বারের মত আদর উপচে উঠেছিল তোমার কথা ভেবেই
কাঁপতে কাঁপতে,ছিঁড়ে খুঁড়ে শেষ হতে হতে বুঝে নিয়েছিল
আদতে প্রিয় পুরুষ শরীর,সদ্য পাওয়া স্বাধীনতার মতই
ঝুরঝুরে নোনা ধরা দেওয়ালের ঘেরাটোপে নিজেকে  আদর করতে করতে আজ অন্তত এটুকু আবিষ্কার কোরো
আজ এই দিনে নিরুদ্দেশ হয়েছিল আমাদের তিরিশটা বসন্ত...




(ছবিঃ পাওলো স্যাবোরিও) 

মধুমাসের কবিতা ১২

Image result for abstract universe painting by famous artist


ভীতু
       -রাজা 

ছিপছিপে হাওয়ায় জট বাধে
শ্রদ্ধা ও ভয়
আমার বিদ্যা- বুদ্ধি নিয়ে রিকশা মহলে
মিথ চালু হয়,যা কি না হাস্যকর,
আদতে পরিত্যক্ত সরস্বতীর নিচে দাঁড়িয়ে
প্রাক্তন প্রেমিকাদের শরীর স্মরণ করি

সন্ধ্যা শহরে মাতাল নামে,
তাস ওড়ে, পাগল গড়াগড়ি খায়
আর ওষুধের দোকানে সিগারেট ধরিয়ে
জীবন'কে আমি
"ফুঁ " বলে ডাকি আবার
ভাললাগে না এই একঘেয়ে বেলাল্লাপনা

ফিরে তাকাই,
জিম সেন্টারের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ভাবি
এবার থেকে সুস্থ হব, সুন্দর হব,
ডাক্তার বাবুর মেয়ে প্রেমে পড়বে আমার

বেঁচে  থাকার প্রতি লোভ যত বারে
ততো ঘিরে ধরে মৃত্যু ভয়
আজকাল মৃত্যু স্বপ্নে দেখি
এক গা ছমছম বৃদ্ধাশ্রম,
সাদা থানের ভিড়ে
মায়ের মত কেউ, তোমারি মত কেউ
ঘুমপাড়ানি গায়

(ছবিঃ লিওনার্দ এইটকেন)

মধুমাসের কবিতা ১১

Image result for absolute space time painting

রাতের আকাশটার দিকে তাকিয়ে আমি ভাবি
                                                         -সুপর্ণা মণ্ডল


এখন বেশি রাত নয়
কালপুরুষ চিনতে শেখা
ভূগোলে শিখিয়েছিল কোনটা গ্রহ, কোনটা নক্ষত্র
বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম, ধ্রুবতারা কোনটা
তারা দেখে পথ চেনার গল্প করে বাবা
আর্মিতে যেভাবে শেখাত
ভূগোলস্যার ঘরের সিলিঙে অনেক তারাদের স্টিকার লাগিয়েছিল
কারেন্ট চলে গেলে সিলিংটা আকাশ মনে হ’ত
রাতের আকাশটার দিকে তাকিয়ে আমি ভাবি
এইসব তারাভর্তি আকাশ বিশাল একটা ঘরের সিলিং বই তো নয়!


(ছবিঃ জন গোল্ডিং) 

মধুমাসের কবিতা ১০


Image result for absolute space time painting

ছোঁয়া নিরাময়
         -পঞ্চতপা দে সরকার

বসন্ত আসেনা একাকী অক্ষরেখায়,প্রান্ত পলাশে রোদের যত কাটাকুটি খেলা,বসন্ত আসবে বলে কোকিলের সংযমী ডাক অথবা নীল চরাচর,সবই ফিরিয়েছি উৎসব মুখরিত হেলায়,
আমাকে ছোঁয়নি ওরা,
শিমুলসিক্ত প্রেমে উপেক্ষা হেনেছি বারবার।
শুধু এক বাদামী ঝলক
হাত পেতে দাঁড়ায় যখন মাধুকরী চোখে,তীব্র ঝুলিতে তাঁর নিজেকেই রাখি নতশিরে।
ছোঁয়া নিরাময় আসে বসন্তের নামে।


(ছবিঃ জিয়ানী মাদারওয়েল)
         




মধুমাসের কবিতা ৯

Image result for space abstract geometry painting

ফেরা
    - উমা মন্ডল

অঘ্রাণ এসে গেল
 সোনালী ধানের বোঁটায় এখন ঋতুরঙ্গের গন্ধ,
ধান উঠবে বইয়ের তাকে
পড়া যাবে হলুদের অভিধান অন্যভাবে।
আলপথে কে কে ব্যাভিচারী চোখে আকাশ দেখেছে
বা সূর্যকে অভিশাপ!
অন্তঃপুরের খবর দেবে ভিক্ষানিবারক।

পাখী দেখে গৃহস্থের উঠানে জ্বলছে সোনালী শরীর
প্রয়োজন মিটে গ্যাছে।
পিষে তেল বার করে উৎসবের জাহাজ
 চলেছে দেশের খবর নিতে,
তারপর সংবাদ-পত্রের পাতায় লেখা হয়ে যাবে
'ব্যাক্তিটি আকাশ দেখছিলো...
দাউদাউ খড়কুটোর কান্না শোনেনি
কেউ শোনেও না....

এখন ধোঁয়া খানিক শান্ত,
উপসংহারের শেষে বাড়তি শব্দের
 ব্যবহার কেউ করে না।
বয়ে যাওয়া সমান্তরাল জল দেখলে
 আমার ডান চোখ কেঁপে ওঠে,
ঠাকুমা বলে অলক্ষণের দ্রাঘিমা....
সময় ফিরে ফিরে আসে
সবাই জানে,শুধু মন্দবুদ্ধির বাস্তুসাপ
কেন বিষ ছড়িয়ে দিলো নিজের উঠানে
সেই প্রশ্নের উত্তর অক্ষর এখনও অধরা  ,
এদিকে অঘ্রাণ আবার ফিরে আসার দিন গুণছে....
                         






(ছবিঃ মিশেল কুরিয়ার) 

মধুমাসের কবিতা ৮

Related image

স্বপ্ন ও ঘোর
          -অ নু স ঞ্জ না ঘো ষ 



স্বপ্ন ও ঘোর সমার্থক হলে আমি ইথার বিছিয়ে দিই তিস্তার এপার থেকে ওপারে। চশমায় জমে ওঠে কালো রাত। পূবের আকাশে ছড়িয়ে পড়ে মেঘ। বৃষ্টিও ভিজে যায় জলের স্পর্শে। নীল একটি অভিমান। গত রাতে খবর পেলাম মন ভালো নেই স্বপ্নের। জ্যোৎস্না পেরিয়ে চাঁদ আর তার মাঝেই মফঃস্বল, রোদ মাখামাখি জীবন। ব্যস্ত শহরের মত জেগে আছে ঘোর, ঘুমের দাবি নিয়ে।

সময় সারনী ধরে হেঁটে গেছে বহু স্রোত, তবু বদলায়নি পাহাড়, নদীও সে কথা জানে। খুব গভীরে প্রবল ভাবে ভাঙছে কিছু। বদলাচ্ছে চশমারর কাচ। বাড়ছে সম্পর্ক আর মন। বহু পাথর গড়িয়ে গেছে, সবুজ ঢেকে দিয়েছে স্রোতের গভীরে জমে থাকা যাবতীয় ক্ষতচিহ্ন।

তবুও কেন্দ্র বিন্দু একটাই। নীলের গভীরে নীল খুঁজে চলা। নিঃশ্বাস থেকে হাতের রেখায় জীবন লিখে ফেলা।

জীবন অর্থেই তোমাকে পাওয়া।



(ছবিঃমার্ক চ্যাডউইক) 

মধুমাসের কবিতা ৭

Related image

আমি
       -কৃপা বসু

     মা, বাবা আর আমি খিদের ভেতর কাঠের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে হাঁটু মুড়ে বসতাম ভ্যাপসা দোকানের সামনে। পেটের মধ্যিখান চিরে কত্ত প্লেন ওড়াওড়ি করেছে ছেলেবেলায়।

     স্কুলশিবিরে ট্রেনিং নেবার সময় ডালিম গাছের গায়ে ইউনিফর্ম ঝুলিয়ে রাখতাম। সব্বোনেশে হাওয়ার পায়ে জোনাকি গুঁজতাম ময়লা ময়লা পালকে ফুঁ দিয়ে দিয়ে।

       ক্রিম মাখামাখির বয়সে মাছ ধোয়া জল গায়ে মেখে বন্ধুদের সাথে স্নান করেছি বহুবার দিঘি পাল্টে পাল্টে। প্রতিবার প্রজাপতির সংসার মরে যাবার পর চিঠির বাক্সে বিঁধিয়ে রাখা মাংসের শরীর জমিয়েছি।

      রাত বাড়লেই মৌতাত বিলোনোর চাকরি করতাম সেলফোনে। কতবার চুষে চুষে ছিবড়ে করে ফেলেছি ল্যাংটো বালিশ। পুরষ প্রেমিকের বীর্য মেখে মুঠোর ভেতর ঝড়ের দিন ভরে রাখতাম।

     নতুন পদবী গায়ে সেঁটে নির্দিষ্ট অ্যাকোরিয়ামে নির্ভুল সঙ্গম সেরেছি। খিদে মিটে গেলে মেঝের ওপর থুক করে ছুঁড়ে ফেলেছে মালিকপক্ষ। এক পা চলার লোক ছিলনা যে, তাকে নিয়ে ঝাঁচকচকে পলাশের দিন গিলে খেয়েছি।

      বন্ধ্যা দেহে বাচ্চা ধরেছি তিন তিনটে। নাড়ি কেটে দুধ দিয়েছি ওদের জিভে। ছাদ ভেঙে আস্ত চাঁদ কুচোকুচো করে কেটে পুরে দিয়েছি জ্যান্ত মুখে। ছেলে মেয়ের দল স্কলার পেয়ে তারা এখন  আমেরিকা, লন্ডন।

     তারপর থেকেই চিৎ হয়ে শুয়ে আছি হসপিটালের বেডে। সময় পেরোলে ম্যাড়ম্যাড়ে সুতির শাড়িরা যেভাবে একলা হয় একটু একটু করে,সেভাবেই উল্টোদিকের ফাঁকা সিটে চুপচাপ বসি। জাগরণী সন্ধের পাশেই শ্মশান সাজিয়ে বসে থাকে সর্বগ্রাসী ডোম।

এতগুলো বছর নিজেকে কেটে টুকরো টুকরো করে প্লেটে প্লেটে পরিবেশিত করার শেষে, আলটিমেটলি বুঝলাম এক বিন্দু বালির দানা ছাড়া আর কিচ্ছু হতে পারিনি, কিচ্ছুনা।




( ছবিঃ সেভারিনি গিনো) 

মধুমাসের কবিতা ৬




জোনাকি ১
                 -পিয়ালী বসু ঘোষ 

বিচ্ছেদ ,রিপু ,চোখের জল
সবমিলিয়ে একটা মনখারাপের রাতে
ফ্লাইংকিসে বেবাক বোকা বনে যাওয়া সওদাগরি ঢেউ
নীলবিষে জর্জরিত কুণ্ঠা
এক কাপ চায়ে ভিজিয়ে খাচ্ছে চাঁদরঙা বিস্কুট
মাঝপথে নাবিক মেতেছে গোপন অ-সুখে
হাতড়ে বেড়াচ্ছে অন্তর্বাসের নিচের লালচে তিল !
আমি একটা গোটা মরশুম পার করে
ক্লান্ত আমার হাইরাইজের কার্ণিশে
অন্ধ জোনাকির সাথে লুকোচুরি খেলছি
অহর্নিশ শুধু
নিশি ডাকছে ,নিশি ডাকছে ........

জোনাকি ২

যেমন করে একটু একটু করে সিঁড়ি ভাঙ্গি
তেমন করেই বিপন্ন যৌবন ভাঙছে
বর্ষীয়ান জোনাকি খুবলে খাচ্ছে মন,সময়,শিশির
''
শুকনো পাতায় মর্মর ,দেখি
তোমার ছায়ারা দীর্ঘ হয়েছে এতদিনে
ডানাছেঁড়া জোনাকি পথ দেখাচ্ছে তোমায় ,ফেরার
"
দুলে উঠছে পাইনের বন ,মূর্তির বাংলো
একলা নদী আর শীত রাতের কনসার্ট
তোমার একাকার মন,বেসামাল পথভুল
আমাকেই খুঁজেছিলে কি ?
সে রাতের সাক্ষীও জোনাকি !

জোনাকি ৩

ছেঁড়া ঘুড়ির মত কেটে যাচ্ছে ছোটো একটা ব্যক্তিগত দিন
পোষা খরগোসের পায়ে নরম রোদ্দুর ছুঁয়ে গেছে বুক পকেটের হলুদ দুপুর
ডানা ছেঁড়া ফড়িংএর বিদ্রুপ ভালোবাসা শব্দটাকে ফর ফর করে হাওয়ায় ওড়াচ্ছে
শারীরিক প্রতিষ্ঠান চন্দন স্নানে সূচী হবার পর
চিতার আগুনে শরীর সেঁকে নিচ্ছে একমুঠো জোনাকি
তোমার অণুগল্পের অভিসন্ধিমূলক চরিত্রগুলোর ইটচাপা অভিমান
আমাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে


(ছবিঃডেভিড গাজদা) 

মধুমাসের কবিতা ৫

Image result for abstract  aztec art


অন্তরাল
          -সুমন সাধু

জলের রং কী? জলের স্বাদ কেমন? এতকিছুর মধ্যেও আমরা জলের আয়তন নিয়ে অলীক মাথা ঘামাচ্ছি।

ও দেশের শিশুরা রোজ কাঁদে আর জেনে যায় কান্নার স্বাদ।
কান্না গলে নরম হয়। বড় নোনতা হয় চুমু খাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তের ঠোঁট।
এক বাবা তার বাচ্চাকে নিয়ে বাঁচার পথে পালিয়ে যাচ্ছেন আর ভাবছেন কালকের জন্মদিনটায় সে অন্তত বাঁচুক। বেঁচে যাক লোল বৃদ্ধ রাজনীতি।


আমরা কেউ সিরিয়া নিয়ে ভাবছি না। অথচ জন্মদিনের কেকে ছুরি বসাচ্ছি রোজ।

( অ্যাজটেক প্রত্নচিত্রের অনুপ্রেরণায় আলেক্সান্ডার আর্সানস্কি) 

মধুমাসের কবিতা ৪

Image result for abstract inca art


পাহাড়
          -শমীক ষান্নিগ্রাহী

১।
লম্বা ঘুমের জন্য
আমার ভীষণ প্রিয় একটা রাত
গল্পের মত সাজিয়ে নিচ্ছে নিজেকে
এসব লিখে ফেলে বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবি
কেউ মনে রাখবে না শীতের দিনগুলি

তার আলো কমে আসে বিকেলে

রাস্তার হদিশ পেয়ে
পাতার পর পাতা শুধু কুয়াশার ভেতর . . .


২।
কত ডাকনাম মনে পড়ে কুয়াশার
আপেল রং এর সাথে বিকেলের সম্পর্ক
কথা বাকী আছে বলে
দাঁড়িয়ে পড়ে শীত . . .
অপেক্ষার অনুবাদে সহজভাবে তাকিয়ে

এখান থেকে আমরা হাঁটা দিই পাহাড়ের দিকে

(ছবিঃ ইনকা প্রত্নচিত্রের অনুপ্রেরণায় জিওর্জিয়ানা রোমানোভনা) 

মধুমাসের কবিতা ৩

Image result for abstract ancient african art

এইসব চুপ থাকা 
                        -রঙ্গন রায় 

চুপ করেছি , শান্ত হতে পারছি কোথায়?
অথচ দেখেছি
অসুস্থ বাড়িতে কোনো অসুখের গন্ধ নেই।
ওহে বাদামী মেয়ে , তোমার দিকে দৃষ্টি দিইনি কখনো
তুমি দিদিমণির মত ভালোবেসেছ শাসনের আড়ালে ,
চশমার আড়ালে -
বলেছো , বাবু ফোন করবে তো? আজ কথা বলবে তো?
আমি বারবার মানুষকে উপেক্ষা করতে ভালোবেসেছি
দেখিনি তার পায়ের ছন্দে 'মরণ তুহু মম শ্যাম সমান' ...
আসলে এতকাল চুপ করে ছিলাম কথা বলবো বলেই


(ছবি ঃ আফ্রিকান প্রত্নচিত্রের অনুপ্রেরণায় ফতেমা আবদুল্লা আবুবকর) 

মধুমাসের কবিতা ২

Related image

হ্যামিল্টন গঞ্জ 
                     -শৌভিক দে সরকার

রোদ লিখি
রোদের কষ বেয়ে উপচে পড়ছে দুপুর
ঈশ্বরের বাড়িঘর লিখি
ঈশ্বরের ছেলেমেয়েদের হাতমোজা
বারান্দায় পড়ে থাকা খেলনা ভালুক
গর্ভবতী ঘুঘু লিখি
মূক ও বধিরদের বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘুঘু
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে
অন্য একটি খাবি খাওয়া দুপুরের দিকে

মাথা ঘুরিয়ে দেখছে
মাংস ঝরে যাওয়া অন্ধ দাঁড়কাক
কলোনির মোড়, দাবদাহের অতীত



(ছবিঃজেস বুর্ডা )

মধুমাসের কবিতা ১

Hyperspace free vector 2560x1600







বছর শেষের রিলে

-জয়ীতা ব্যানার্জী গোস্বামী 

     (১)
গোটানো সুতোর চাঁদ 
নিঝুম পাড়ার গতি ।একটি মাত্র মাকু ,সচল
নতুন গামছা বেচে কিনেছে কর্কট

ফুলে ওঠা চৈত্রমাস । ফের
চতুর্থটি এঁটে আছে অনায়াসে দ্বিতীয়ার কোলে
                  এবং বেলার শেষে,
ঘামের কলম ঝেড়ে আবেদন পত্র লেখা সেরে
বাড়তি গামছা বেঁধে ফেরে তার বেকার তিরিশ       

(২)
সারসের ভেজা ঘ্রাণ
ধূসরের আগে ও পেছনে অপয়া পালক বেছে
ভাসিয়েছে জলজ দেবতা । বাকিটুকু নৈবেদ্যর পাতে

তখনও জীবিত কেঁচো কিছু গড়িয়ে নেমেছে । ঠোঁটে
বিগত দিনের যত পরিযায়ী এঁটো ছুঁয়ে ছুঁয়ে
সাজিয়েছে ফুল । আজ বাসন্তীও যাবেন ভাসানে 








(ছবিঃ অ্যালবার্ট হফম্যান )