সে আলো, লাজুক নয়, সপ্রতিভ দ্যুতি
-অনিন্দ্য রায়
তখন আমার শরীর ভালো নেই। সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে গেছি এক গুমোট সন্ধ্যায়। ওষুধ আর বাড়ির শাসনে আস্তে আস্তে রিকভার করছি। উঠতে গেলে মাথা ঘুরে যায়, বাড়ি থেকে বেরোনো মানা, সে এক অসহ্য জুলাই, ১৯৯৫ । সারাদিন বসে থাকি, একা, টুকটাক পড়ি, কনসেনট্রেট করতে পারি না, মাথা ভারী হয়ে আসে। সারাদিন এক অসহনীয় পাথর শরীরে নিয়ে বসে থাকি। বিকেলে ঝাপসা হয়ে এলে সে আসে। সে জয়, আমার আনন্দ। তারপর আমাদের গল্প, বাংলা কবিতা নিয়ে, পাশ্চাত্য সঙ্গীত নিয়ে। ওটুকুই আমার বেঁচে থাকা ওই দিনগুলিতে। জয় ওর ডাকনাম। শুভব্রত দত্তগুপ্ত। আমার শহর ছেড়ে কলকাতা চলে যায় কিছুদিন পর, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ওর কাজের জায়গা ।এবং বিজ্ঞাপন। হ্যাঁ, কবিতা লেখে।
২০০০-এর বইমেলায় বেরোল ওর প্রথম কবিতার বই, লাজুক অন্ধকার।প্রকাশক প্রথম আলো, তরুণ চট্টোপাধ্যায়। দাম : পাঁচ টাকা। এক ফর্মার কাব্যপুস্তিকা ।
উৎসর্গ : মা ও বাবাকে ।
নদীর গল্প বল... বারান্দায় মোড়া টেনে বসি
লাস্ট ট্রেন চলে গেছে শিবুদের পাঁচিল কাঁপিয়ে
পকেটে নারকেল ভাজা নিয়ে কাকদ্বীপে যেত যে কিশোর
আজকাল
সে রাসেল স্ট্রিটে পাথর ভাঙছে
আমাদের পশমহীন জীবনে কেবল টায়ারের গন্ধ
শিরীষকাগজে এই অবিরাম মুখ ঘষা, হাড়ের নৃত্য দেখে
শিরদাঁড়া ভিজে যাওয়া মাঝরাত্তিরে
আমরা কি কোনোদিন মুখ তুলে চিল দেখবো না?
নদীর গল্প বল,
যে আমার অভিমানে জলছড়া দেয়।
( সুজনেষু )
এমনই মায়াময় তার কবিতা। তার বই।প্রতিটি শব্দ পাঠককে আবিষ্ট করে ।
আমাদের আলোচনায় প্রায়ই উঠে আসত ‘ট্রান্সক্রিয়েশন’ শব্দটি। নিজের চারপাশে দেখা দৃশ্যকে, ঘটনাবলীকে কবিতায়, ভাষায় আবার নতুন করে নির্মাণ করা। আর সে নির্মিতি কবির সম্পাদনায় হয়ে উঠবে এক নতুন দৃশ্য, নতুন ঘটনা, নতুন পৃথিবী – এই, ছিল আমাদের বোঝাপড়া তখন।
শুধু শিল পড়ার শব্দ ।
জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকছে কড়িবরগাহীন রাত
ডুবে যাচ্ছি অন্ধকার হাত রাখছে কোমরের নীচে
সমস্ত জীবন একটা কফিনের মধ্যে শুয়ে আছি,
শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে লবণাক্ত মেঘ ।
পর্দা সরিয়ে আজ বাইরে তাকাও
সেই রাস্তা খুঁজে নিতে হবেই তোমাকে, যেখানে
রাতের সঙ্গে হোলি খেলছে চতুর্দশী চাঁদ ।
( পুর্বাচলকথা )
কোথাও হোঁচট খায় না তার উচ্চারণ, সাবলীল। চিত্রকল্প থেকে চিত্রকল্পে অনায়াসে নিয়ে যেতে পারে আমাদের। তার চারপাশের বিনির্মাণ ও নবনির্মাণ এক সুর তৈরি করে, এক আলোছায়ায় প্যাটার্ন তৈরি করে চেতনায়।
তোষকের মধ্যে ঘন পূর্বজীবন
সুষুম্নাপোকা জানু পেতে আলো ভিক্ষা করে ।
উঠে ডাঁড়ায় আসমানে
কড়িকাঠ ছুঁয়ে আছে সবুজ মিনার । দলবেঁধে
মেছুনীরা আসে
হৃৎপিণ্ড কাদা হয়, জন্মের প্রথম দিক অনেকটা
রুটির মতোন
চাঁদের চর্বি লেগে তৈলাক্ত মুখ । কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে
অন্ধকার পায়ের আঙুলে ।
শালিখের পাশে দিঘি, হলুদ কুশূল-মেঘ
ভিনিগার ঢালে ঈষদুষ্ণ চুলে
( তৃণজন্ম )
রিয়েলিটি ও কল্পনা মিলেমিশে যায় তার লেখায়, নীচু স্বরে বর্ণনার মায়ায় সে আমাদের অন্য এক রিয়েলিটির মুখোমুখি দাঁড় করায়।
দু’সমুদ্র আর্তনাদ ড্রয়ারের নীচে
দুটো পেন পরস্পর মাথা বদল করে । আবছা কিনারে দাঁড়িয়ে জলের কেশরে হাত
দিয়েছি, কখনো প্রহরী রহস্য টের পেয়েছিল। পিরানহা ছেঁকে ধরে নিখিল
কবজি । বুঝি, এক বালিশের হুল অন্য কানে পালক হয়েছে ।
প্রথমে সবুজ ছিল টুপিবোনা উল্ । তাঁবু ছেড়ে উঠে আসছে আপৎকালীন চোখ ।
নৌকো চালনায় যুবা দক্ষ নয় বলে গিরগিটি গায়ে ডিম পাড়ে – নিদ্রালু ডিম;
আমিষ শুক্রগন্ধে সন্তপ্ত হরিণপৃথিবী ।
( ডিম )
কলকাতা গেলে আমাদের দেখা হয় মাঝেমধ্যে।
আমার মা যখন অসুস্থ নিজের কাজ শেষ করে দেখা করতে আসত ঠাকুরপুকুরে। তারপর রাত্রি যখন সান্ত্বনাহীন, ফিরে যেত সল্টলেকে।
আমার জীবনের দুই চূড়ান্ত অসময়ে সে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে, হাত রেখেছে কাঁধে।
একদিন ক্যুরিয়ার একটা খাম দিয়ে যায়, খুলে দেখি কার্ড, বিয়ের কার্ড, জয়ের ।
তাতে ‘ দুই হাতে দুই মশাল দিও/ শান্তিও চাই অশান্তিও’ এই অমোঘ বার্তা মুদ্রিত।
নিজের কাজের জগতে পরিচিতি বাড়তে থাকে তার। গানে ও বিজ্ঞাপনে সে তখন রীতিমতো নাম, জয় দত্তগুপ্ত।
আরেকটি কবিতার বই বেরোয় ।
তারপর?
লেখে না আর? পত্রপত্রিকায় দেখতে পাই না তো।
কবিতা থেকে সরিয়ে নেয় নিজেকে।
নব্বইয়ের এ এক প্রবণতা, লেখালেখি থেকে সহসা নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। অন্য কোনো মাধ্যমে ব্যস্ত হয়ে পড়া।
জয়ের স্নগে ফোনে কথা হয়, কবিতার কথা উঠলে বলে, “ শুরু করেছি আবার”।
হ্যাঁ, আমার বন্ধু আবার কবিতায়, স্বচ্ছন্দে, ঝকঝকে, আদ্যন্ত স্মার্ট শুভব্রত।
বলছি তো, একটুও লাজুক নয়, একটুও অন্ধকার নয়, আলোর আদর লেগে থাকে তার হাসিতে, তার কবিতায়।
(ছবিঃ জর্জেস ব্র্যাক)
No comments:
Post a Comment