Tuesday, 19 December 2017

আশ্চর্য্য ধারাবাহিকঃ হারিয়ে যাওয়া নব্বইঃ পর্ব ৫

modern art paintings artist Bianchini


“খালিহাতে নিখুঁত বৃত্ত আঁকার কৌশল” 
                          -অনিন্দ্য রায়

“ ...and  I  too play a  guitar -  but sometimes I play the  fool” প্রথম কথা এই ছিল আমাদের,হ্যাঁ, লেনন ছিলেন আমাদের পরিচয়ে । কিছুদিন হল  বিটলসের কিশোরবেলার গানের অ্যালবাম ‘Live at BBC’, তাতে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে এই কথাগুলি বলেহিলেন জন লেনন । মধ্যনব্বইয়ের এক দুপুরে এক কবিতার আসরে তার সাথে আমার আলাপ, বাঁকুড়ায় ।ছিল এপ্রিল, ভিড় থেকে সরে গেশ্টহাউসের নিঃসীম বারান্দায়, যেন গেরিলা-স্ট্র্যাটেজি বোঝাচ্ছে এরকমই গোপনীয়তায়,সে আমাকে কবিতা শুনিয়েছিল , যা পরে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
 আর কোনোদিন দেখা হয়নি আমাদের, এক দুপুরের দেখা, তবু কেন জানি না আজও তাকে বন্ধু মনে হয়, খুঁজতে খুঁজতে যখন তার সেদিনে শোনানো কবিতাগুলির কিছু পেয়ে যাই পত্রিকার পাতায়।  আমাদের নব্বই এমনই তো, এমনই তো বন্ধুত্ব আমাদের, কবিতা আমাদের। ফোন নাম্বার দেওয়ানেওয়া ছিল না, ফেসবুক ছিল না, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ছিল না, কিন্তু আমরা বন্ধু হয়ে যেতাম, সে বন্ধুত্ব কবিতার । 
শেষরাত্রে সমস্ত ঢেউ এসে থামে এই স্বাস্থ্যানাসের গোলবারান্দার নিচে। সম্পূর্ণ সকলটা
ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে কুয়াশায় ঢাকা নরম, গভীরে এক দ্বীপ । তার উষ্ণ স্রোতের পাশে
লুকিয়েছে সেইসব গাছ । যারা
সরুসরু লম্বা পাতা ঝুঁকে পড়ে বালির ওপর উড়ে আসে কোনো দূরের শহরের থেকে
বৃদ্ধ ব্যান্ডবাজিয়ের পালকবিহীন
নীল টুপি । কাল সারারাত, বাতিঘর ঘিরে যেন নেচে গেলো পশমী চাদরঢাকা শীত
নক্ষত্রেরা ... সংখ্যায় ছয় ; ভেসে ওঠা নৌকার শব্দগুলি ছুঁয়ে, ভাঙা
ব্রিজ ঢেকে দেওয়া কুয়াশার স্তর
দু’হাতে সরিয়ে উঠে আসে সারসার চাঁদ পরিত্যক্ত কারখানা চত্র্বর জুড়ে, পুরোন অস্ত্র আর
পিচ্ছিল জলপাই পোষাক শরীরে ;
ওরা জেনেছিলো, রাতের সীমানা আর হলুদ টিলার পাশে খুঁজে পাওয়া যাবে বড়, গোল
তারাটিকে । প্রাচীন গ্রীস্ম-অঞ্চলে সেই গল্প ছুঁয়ে যাবে পাথরের বাড়িঘর, দীর্ঘ
প্রান্তর জুড়ে নেমে আসা
বেঁটে বেঁটে বাদামী ঘোড়ার দল । সন্ধ্যায় হাওয়ালন্ঠন হাতে ঊঠে আসে আলখাল্লা ঢাকা
এক অবয়ব, ঝাউবাংলোর এই
কিন্তু জানলার পাশে । বাইশবছর আগে তবে কি বলেছিলে আলোর সময় ?
বাতাসের ো লবণের স্তর ? জেগে ওঠা নাবিকের বিভিন্ন মানচিত্রে হঠাৎ আলোকবিন্দুগুলি ?
তুমি ? নাকি মোমবাতি ? প্রতিটি জন্মদিন ছুঁয়ে যাও । সন্ধ্যায়
নিচু নিচু কাঠের বেঞ্চিগুলো ভ’রে ওঠে কামিনের ভিড়ে, দিশি মদ, শস্তা কড়া
তামাকের ধোঁয়া তারা প্রেমের গল্প শোনে, ডিসেম্বরের,
গীর্জার চূড়া বেয়ে নেমে আসা রোদের গল্প ... সেই দীর্ঘ হ্রদের পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া
আমার কাঠের গাড়ি, মেয়েটির দিকে শিশুদের দল, দ্যাখো, দস্তানা ভ’রে ছুঁড়ে দিচ্ছে
মুঠোমুঠো খনিশহরের এক শীতের সকাল ...
( গ্রিটিংস কার্ড – ৩ )
এমনই এক আশ্চর্য ভাষ্য, মগ্ন মনোলগ তার কবিতা, পরাবস্তবতা ছুঁয়ে থাকা উচ্চারণ । দীর্ঘ পঙ্‌ক্তি, দীর্ঘতর বাক্যবিন্যাস আর একেবারে তাজা,প্রাণবন্ত বাক্‌শস্যের মুখোমুখি আমরা। এই তো নব্বই, হ্যাঁ, নব্যই, নতুনতর ।
... এরপর দূরে ক্রমশ নিভে আসতে থাকা সেই পাথরের বাড়িঘর ছাড়া আর কিছুই নেই
ঘোরানো লোহার সিঁড়ই উঠে এসেছে ওপরে যেখানে দু’টি
খনিজ হাত ক্রমাগত পিছিয়ে যেতে থাকে এক অলৌকিক
অন্ধকার শীতের সন্ধ্যায় আবছা কাঁচের ওপর ভেসে ওঠে
শেষ নভেম্বরের বৃষ্টিতে আচ্ছন্ন হয়ে আসা মিশনারি স্কুলের
মাঠ আর দুয়েকবিন্দু কবেকার প্রাচীন লণ্ঠনের আলো ঘিরে
অবিকল ফাদার অ’ব্রায়েন-র গ্লায় কারাযেন বলএ ওঠে

“ এ’বছর প্রবালপোকাদের আক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আমাদের মানচিত্রে সংযোজিত হলো
আরো ছ’টি নতুন দ্বীপ...”

এরপর ঝাপসা হয়ে আসা পার্কের বেঞ্চ সরুসরু লালচে বাদামী
পাতা পড়ার শব্দ ও তার পাশে মদ্যপ যুবকটিকে লক্ষ্য করে
মেয়েদের দল ... অথচ কেউ জানতে পারলো’না খুব ধীর উত্তাপে
বিকিরণ করতে থাকা সবুজ নক্ষত্রটি কখন নেমে পড়েছে শহরের
একপ্রন্তে আর তার আলোয় ক্রমশ দীর্ঘ হ’তে হ’তে একসময়
মিলিয়ে যাওয়া ভিনদেশী নাবিকটির পরিচয় ... যে তাকে শেখায়
খালিহাতে নিখুঁত বৃত্ত আঁকার কৌশল ...

যুবকটির মাথার ভেতর থেকে এখন বেরিয়ে আসছে একের পর এক অসংখ্য সাদা পৃষ্ঠা

আর সে লিখে চলেছে বাইশ বছর পর ফিরে আসা পুরাণ
খনিশহর জুড়ে শুধু করাতকলের শব্দ আর সদ্য গড়ে ওঠা
কফিনকারখানায় কর্মব্যস্ততা দু’একবিন্দু কবেকার প্রাচীন
লণ্ঠনের আলোয় ফুটে ওঠা মিশনারি স্কুলের মাঠ আচ্ছন্ন করা
শেষ নভেম্বরের বৃষ্টি এক শীতের সন্ধ্যায় অলৌকিক অন্ধকারে
পিছিয়ে যেতে থাকা দু’টি খনিজ হাত ওপরে উঠে আসা ঘোরানো
লোহার সিঁড়ি আর সেই পাথরের ঘড়িঘর নিভে আসতে থাকে
আরো দূরে ...

এরপর রেলিঙের ওপাশে তীব্র খাদ আর ভাসমান তরল মেঘে মেঘে আমার ছায়া ।
এ’ছাড়া আর সবকিছু আস্তে আস্তে ঢেকে যাচ্ছে আবছা কাঁচের তরল...
( গ্রিটিংস কার্ড – ৪ )
সেই একবার, আর দেখা হয়নি আমাদের । তবু  তার কথা ,এই কবিতাগুলির কথা মনে রয়ে গেছে। স্বপ্নদৃশ্যের বর্ণনা যেন, এক অন্য পৃথিবীর কথা বলে অথচ সাবলীল, মনে হয় প্রথম শুনছি অথচ খুব চেনা এমনই কবিতা তার।খালিহাতে নিখুঁত বৃত্ত আঁকার কৌশল – সে রপ্ত করেছে তখনই । 
আমার শহরে তবে মৃত্যু বলে আর কিছু নেই ? রাস্তায় ছড়িয়ে রয়েছে
ত্রিকোণ আলোর টুকরো আর জানলার নিচ দিয়ে একে, একে হেঁটে গেল সেই
তিনশো পঁইষট্টিখানা উন্মাদ হাতঘড়ি ...
( গ্রিটিংস কার্ড – ৪ )
তার লেখাও যে আর খুব বেশি পড়েছি তা নয়, তবু মনে আছে তার কবিতাকে, তাকে।
পাঠক, সে কি আপনার চেনা? আমার সেই এক-দুপুরের বন্ধু ।
নাম ?
রণজিৎ দাশগুপ্ত ।
কেউ খোঁজ দিতে পারবেন তার?
এই গান অসম্ভব দ্রুততায় শেষ হয় ... যত দ্রুত গোপন আগুন
ঘিরে ফেলে ঘাসবন ও ঘুমন্ত তোমাদের মেধাহীন চোখ, বাসভূমি ।
বাগানের শেষপ্রান্তে, আলোকিত চতুষ্কোণ মাঠে, সারিবদ্ধ পালকেরা
উড়ে আসে । লক্ষ্য ক’রে, কাঠের কেবিন থেকে, জংশনশহরের এ
দিনলিপি লেখার দায়িত্ব থেকে, অব্যাহতি নিয়ে যেতে চাই ...
‘শেষ কবিতা’ এই লেখাটির শিরোনাম, এটিই আমার পড়া তার শেষ কবিতা। অব্যাহতি নিয়ে সে কোথায় যে চলে গেল? কোথায়, রণজিৎ ?
ও, হ্যাঁ, বিটলসের যে ট্র্যাকটির কথা বলছিলাম, ওই যে লেনন , sometimes I play the  fool, হ্যাঁ, তার নাম জানেন কী ? ‘বিটলস গ্রিটিংস’।

আমাদের বন্ধুত্বের জন্য, নব্বইয়ের জন্য এই গ্রিটিংস কার্ড নামিয়ে রাখলাম ।

(ছবিঃ তাসিয়া বিয়াচ্চিনি) 

No comments:

Post a Comment