‘আমাকে জলের কাছে ঋণী রেখে গেছে’
-অনিন্দ্য রায়
তখন আমি বর্ধমানের এক চোখের হাসপাতালে কাজ করি । ২০০৭-০৮ । সেইসূত্রে প্রতি শনিবার দেবীপুরে আউটরিচ ক্লিনিক করতে যেতাম। প্রতিবার যখন স্টেশনে নামতাম মনে পড়ত একটি নাম, একটি ঠিকানা
গৌতম দাস
গ্রাম ও ডাকঃ দেবীপুর
জেলাঃ বর্ধমান
পিনঃ ৭১৩১৪৬
হ্যাঁ, মনে পড়ত, সে এক সময় ছিল আমাদের, এই ঠিকানায় চিঠি লিখেছি, সম্বোধন ,
সুজনেষু,
সম্পাদক, নির্যাস ।
কবিতা পাঠিয়েছি ব্রাউন খামে ভরে এবং মুদ্রিত হওয়ার পর পত্রিকা ডাকযোগে সেই পত্রিকা পৌঁছে গেছে আমার ঠিকানায় । প্রথম যেদিন স্টেশনে পা দিই মনে হয়, দেবীপুরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কতদিনের পুরোনো । হ্যাঁ এভাবেই চিঠিতে, কবিতায়, পত্রিকায় একেকটা গ্রাম, একেকটা শহর, একেকটা জায়গা চেনা হয়ে যেত আমাদের, আমাদের নব্বইয়ে।
পরে পত্রিকাটির ঠিকানা বদলে ডায়মন্ডহারবার থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। বদলে যায় সম্পাদকের নামও। গৌতম ব্রহ্মর্ষি - এই নামে তখন লিখতে শুরু করেছেন পূর্বোক্ত গৌতম। ' বিষ ও বিস্তার' তাঁর কবিতার বই। বাঁকুড়ায় এক কবিতার অনুষ্ঠানে ১৯৯৫-এর এক নৃশংস এপ্রিলে কবি বইটি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। প্রকাশকঃ পত্রলেখা। প্রথম প্রকাশঃ আশ্বিন ১৪০১, অক্টোবর ১৯৯৪। প্রচ্ছদঃ শ্যামলবরণ সাহা । রচনাকালঃ১৯৯০-৯৩ ।
টাইটেল পেজসহ মোট ৫৬ পৃষ্ঠা । ৪৩টি কবিতা, তিনটি পর্বে বিভক্ত, যথাক্রমে ‘কুহকের চর’, ‘কুয়াশার জন্মকথা’, ‘বরফের ছেলে’।
গোপন পিপাসা ছেড়ে চলে যেতে হবে
এখন নিঃসঙ্গ মেঘ শুয়ে আছি খোলার ভেতর
বৃষ্টি ও সবুজ খেয়ে যে পাখিটি উড়ে যায় রোজ
এ বসন্তে আমি তার পালক ছিঁড়িনি
বরং সে বর্ণময় আমার ডানায়
দুলে ওঠে নির্মেষ, দাঁড়ে
২৭•১০•৯০
( দাঁড় )
এইটি প্রথম কবিতা বইটির । এই দুলে ওঠা, এই সংকেতময় উচ্চারণ তাঁর আপন মুদ্রা । কুহক, অদ্ভুত আকর্ষণী শক্তি নিয়ে ভেসে ওঠা এক ভাষার চর, পাঠকের দৃষ্টিতে দেখা যায় কিছুটা, বাইটুকু ব্লার্ড, সেই অংশটুকু কল্পনায় ভরিয়ে নিতে হয়, এই তাঁর কবিতা।
ধুয়ে আছে লাবন্যময় মুখ । থামো ।
আঁকড়ে ধরে । ফিরব না আর । অনন্ত বিস্তার ...
পাথর ক’রে নেব তোকেও শাপে
২১•২•৯৩
( মৃত্যু)
স্বভাবতই মিতকথন এবং পূর্ণতা তাঁর কবিতার বিশিষ্টতা । সেই সময়ের সিরিজ লেখার প্রবণতা থেকে ভিন্ন একেকটি কবিতার নিজস্ব শিরোনাম, তা কবিতাটির মূল ভাবনা, এই তাঁর রীতি, একটি মাত্র কবিতা, বইটিতে, তিনটি পর্বে রচিত, বস্তুত তা একটিই কবিতা।
খেউড়ে কেটেছে বেলা
পোড়াহাড় এবং পানীয়
জ্বালাতে চেয়েছে আলো
পাঁকজলে অন্ধকার নড়ে ওঠে,
মহিষের পিঠ
২
জলের করাত ছুঁয়ে তোমাকে চেয়েছি
আরও এক পুঞ্জীভূত আলো
ধ্বনি থেকে ভেসে যায় প্রধান অক্ষরে
৩
জলেও ভেতরে ঢেউ যেইভাবে
মাছের ভেতরে ঘোরে জল
জলের বঁড়শি মুখে
ছড়িয়ে পড়ছে তার আঁশ
আর সে মেছুড়ে এক অন্য চারে ছিপ টেনে তোলে
দেখি তার সবুজ ফাৎনা জুড়ে
ভেসে আছে আমাদের অলীক প্রবাস...
৩০•৭•৯৩
( জল )
এবং কবিতাগুলি সংহত, আবেগ নিয়ন্ত্রিত ।
দর্শন তাঁর কবিতার ভিত্তিভূমি।
কায়ার মধ্যে যেমন ছায়া
ঘুরতে ঘুরতে শেষ হয়ে যায় জন্মইতর
এখন আমি দাহ্যতরু
উৎস কোথায় ?
জন্মজলে দাঁড়িয়ে দেখি
চারণভুমি ।
১১•৮•৯২
( চারণভুমি )
এই তাঁর ভুবন । পাঠককে আকৃষ্ট করে, আবিষ্ট করে।
জলের নিচে উন্মোচন
জলের গ্যাস রাতপচায়
রাতজাগায় বিস্ফোরক
ভবিয্যের গাছ আমি
জীবনরস জীবনরস
জলশিরীষ নিই চুষে
শস্যবিষ এবং তার
অন্ধকার সামগ্রী
পাতার পাতা তস্য পাতায়
পুড়ছে কী ফুটছে কি
খই যেন !
ঝোলঝলে চমৎকার রান্নাঘর তৈরী হয়
রোগমুখে শব্দভাত
১১•৮•৯২
( উন্মোচন)
তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক জড়িয়ে ছিল অনেকদিন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর কবিতা পড়তাম। ‘নির্যাস’-এ লিখতাম নিয়মিত।
কিন্তু আস্তে আস্তে তাঁর কবিতা আর দেখতে পাই না সেভাবে। তাঁর কাগজেও আমার লেখা পাঠানো হয় না।
এখনো কি লেখেন তিনি ? সেই ‘বরফের ছেলে’ এখনো কি লেখে ‘কুয়াশার জন্মকথা’?
দেবীপুরে, প্রতিদিন, ক্লিনিকে ঢোকার সময় ভাবতাম, কেউ এসে বলবেন, ‘ আরে অনিন্দ্য! চিনতে পারছ ? আমি গৌতম ।”
বলে উঠবেন
গর্ভে চাঁদ । সে ঘুমোতে পারে ?
শুধু পাকের ভেতর নড়ে আলো
আলো ঘিরে জল কলরব
একদিন নামে উৎসমুখে
কি অমল কাতরতা
রাত্রির শিয়রে আজ শরীর নিঃসৃত
শ্বাস লোহাজলে ভাসতে ভাসতে
নেমে আসে রূপালী মাছের মতো আলো...
২৩•৯•৯০
( জন্ম )
আজ আমি আর দেবীপুর যাই না। কিন্তু অপেক্ষাটা রয়ে গেছে।
গৌতমদা, আপনার কবিতা আরও আরও পড়তে চাই ।
গৌতমদা, কেমন আছেন ?
মনে আছে, একদিন, ‘জলের করাত ছুঁয়ে তোমাকে চেয়েছি’ ?
মনে আছে ?
সর্প দংশন হয়েছিল । সেই থেকে
বিষ ও বিস্তার
আমাকে জলের কাছে ঋণী রেখে গেছে
( বিভাব কবিতা / বিষ ও বিস্তার )
বিষ ও বিষ তার, বিষ ও বিস্তার, হ্যাঁ, আমাকেও ঋণী রেখে গেছে, তাঁর কাছে, সময়ের কাছে
(ছবিঃ মরিস সাপিরো)