Tuesday 15 May 2018

বৈশাখের আশ্চর্য ধারাবাহিকঃ হারিয়ে যাওয়া নব্বইঃ পর্ব ১০

Image result for red summer abstract image


“কাঠকয়লা কখন কলকাতা ২০/২০ হয়ে যায় ।”
                    - অনিন্দ্য রায় 

 “Loneliness can never be substituted, it’s like a lonely mirror in a lonely room.”  এইরকম এক অথৈ বাক্য লিখে সে শুরু করল কবিতা, বাংলা কবিতা, আর নিঃসঙ্গতার গায়ে লেখে থাকা আলো, নিঃসঙ্গতা থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা আলো এসে পড়ল পাঠকের চেতনায় ।
তার নাম পাথি, বেশ বড়োসড়ো চেহারা, দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়ালে মনে হত, এই বুঝি উড়ে যাবে । বাঁকুড়ায় কালীপুজোর এক উথালপাথাল সন্ধ্যায় আমাদের দেখা । নব্বইয়ের মাঝামাঝি । পরস্পরের কবিতার সাথে আগেই পরচিতি ছিল, তখন সে ‘কবিতা ক্যাম্পাস’-এ নিয়মিত ।আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন পল্লবদা, প্রিয় পল্লব রায়, মনে পড়ে । তাকেও মনে হয়, তার কবিতারই মতো “like a lonely mirror in a lonely room.”  । যদিও  আর দেখা হয়নি আমাদের, একদুবার ফোনে সামান্য কথার টুকরো বাদ দিয়ে আর কিচ্ছু নেই আমাদের মাঝখানে ।
 আর লেখাও পড়ি না ওর ।
 গত ৪ এপ্রিল পল্লবদা হোয়াটসঅ্যাপে একটা পিডিএফ পাঠান আমাকে, সাথে লেখা, “ পাথির ১ম ও শেষ বই পাঠালাম ।”
 ডাউনলোড করে পড়তে শুরু করি। নাম ,’ কলকাতা ২০/২০’ শিহরিত হই, এই এতদিন পর পাখির লেখা পড়ছি । সেই একই আবেগ, সেই একইরকম ফ্রেস, যেন এই মাঝের এতগুলো বছর সে ঘুমিয়ে ছিল, হঠাৎ জেগে উঠে লিখতে শুরু করেছে । ২০/২০ ক্রিকেটের মতোই টানটান, উত্তেজক ।
কেবল, “ জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার” ।
“ প্রায় কুড়ি বছর ধরে একটা ঠাণ্ডা প্লাস্টিকের ব্যাগের ভেতর কয়েকটা বিষণ্ণ প্যাড । কিছু হলুদ আলগা কাগজ । ভালবাসায় মর্চে পড়া তিনটি ডায়েরি । আর অনেকটা অন্ধকার । অন্ধকার থেকে উঠে আসা, এ বইয়ের সিংহভাগ লেখালেখি গত শতাব্দীর অন্তর্গত । বিরানব্বই থেকে ছিয়ানব্বই পর্যন্ত । তারপর লম্বা ঘুম । খওয়াদাওয়া । আর আত্মরক্ষা ।” লিখেছে পাখি, বইটির শুরুতে ।
৮ই এপ্রিল আমি ফেসবুকে লিখি বইটি নিয়ে । কেউ কেউ পড়তে চান । আমি পিডিএফ ফরোয়ার্ড করি ।
শুভ আঢ্য বইটি নিয়ে তার পাঠপ্রতিক্রিয়া জানায় ফেসবুকেই । এবং জানায় যে, সে পড়ে চমকে গেছে । আমার কাছে বইটি পেতে চান অনেকেই, ফরোয়ার্ড করি। বিভিন্ন ওয়ালে বইটি নিয়ে হইচই ।
কিন্তু কোথায় পাখি ?
যেন স্বেচ্ছা নির্বাসনে ।
তার বই তো এখনো প্রকাশিতই হয়নি, প্রকাশকাল লেখা আছে ডিসেম্বর ২০১৮ । আমি যেটা পেয়েছি, পড়তে দিচ্ছি, সেটা প্রাথমিক পাণ্ডুলিপি ।
প্রথম পৃষ্ঠার ওপরদিকটা ফাঁকা । নীচে, একেবারে নীচে লেখা দুটি পঙ্‌ক্তি
“ চুনের দেওয়ালের ওপর কাঠকয়লা দিয়ে কাঠকয়লা লিখি  ।
লিখতে লিখতে কাঠকয়লা কখন কলকাতা ২০/২০ হয়ে যায় ।”
বইটির প্রকাশক দেবরাজ চ্যাটার্জি, ও হ্যাঁ, বলা হয়নি, দেবরাজ চ্যাটার্জি পাখিরই নাম ।
      “ ওঁ গঙ্গা

সে ক্রমে নির্জন এবং একাকী
তার যাবতীয় বিষণ্ণতা অতিক্রম করার জন্য
সে ক্রমে ঈশ্বর
তৈরি করে অন্য এক উপত্যকা
   অন্য আকাশ, বৃক্ষশ্রেনী –
অন্য এক কলকাতা শহর ।”
এই বিভাব কবিতা । শুরু হচ্ছে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানপত্রের “ওঁ গঙ্গা” শিরোনামে । কীসের অন্তিম ক্রিয়াকর্ম করতে চায় সে ? যাপনের ? কবিতার ? জীবনের ?
লিখেছে সে, “ এই বইয়ের অনেক কিছুই নেই । প্রকাশক নেই । কপিরাইট নেই । কোনো বিনিময়মূল্য নেই । তাই বোধহয়, ভালবাসার মানুষও নেই।”
না, বন্ধু, ভালবাসার মানুষ, মানুষকে ভালবাসার মানুষ যে আছে, এখনও আছে, তা বোধহয় তুমি টের পাচ্ছ ।
‘বিনিময়মূল্য’ শিরোনামে লেখা,
       “ চুমু হোক, চাঁটি হোক, একটু ভালো লেবুর চা হোক, হাসি হোক, বাসি হোক, একশো-দুশো
  টাকা হোক, কোক হোক, ফোক হোক...
...
  অনেকটা লম্বা হাঁটা হোক, অসম্বব সব গল্প হোক, সুকুমার রায়ের ভালো হোক ।”
সূচিপত্রের আগের পৃষ্ঠায় লেখা
“ জীবনানন্দ ঘরে ফেরে নাই ।”
আমরাও গৃহত্যাগী হই, অনেকটা লম্বা হাঁটায় সঙ্গী হই পাখির ।
সে হাঁটা দ্রুত শেষ হবে হওয়ার নয়, তাই আগামী সংখ্যায় আবার পাখি ।

(ছবিঃ আলেক্সান্দ্রা রোমানো)


No comments:

Post a Comment