একজোড়া চোখ ডাকে আমায়
-মীম মিজান
হেমন্ত কেবলি বাংলা মায়ের শাড়ির আঁচলে রঙ মাখাবে। মাত্র দু'দিন অতিবাহিত। নিম্নচাপের দরুণ চারনম্বর সতর্ক সংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বৃহস্পতিবার রাতথেকেই ঝরছে তো ঝরছেই আকাশ। দমকা একটু বাতাসও সঙ্গী।
দায়ে পড়েছে যারা তাদেরকেই শুধু দেখছি ঢাকা শহরের কাদামিশ্রিত হাঁটু পানিতেও পথ চলতে। দূর-দূরান্ত থেকে ক্ষ্যাপ দেওয়া রিক্সাচালকরাই শুধু কাকভেজা হয়ে রিক্সা চালাচ্ছে। নানা নম্বরের বাসগুলো জানালা বন্ধকরে যাত্রী হাঁকছে। বাসের সিট ও করিডোরে অকাল বর্ষার জল।
জীবনের ক্রুশিয়াল মুমেন্ট না ছাত্র না চাকুরীজীবী। এরকম যখন ইমেজ সংকটের মূহুর্ত তখন এই বৃষ্টি পারে না আটকাতে আমাকে। মহাখালী থেকে আজমিরি বাসে উঠলাম। গন্তব্য ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ। কলেজে পৌঁছলাম পরীক্ষার তিনঘন্টা আগেই। সেখানে আমার মতো একজন ইমেজ সংকটাপন্নের সঙ্গে জমালাম আড্ডা।
অতপর বিকেল সাড়ে তিনটায় পরীক্ষা শুরু। আমার জীবনের এই এক ঘন্টার পরীক্ষা শেষ হলেও বাইরের অঝোর বর্ষণের একটুও কমতি দেখলাম না। ভিক্টোরিয়া পার্কের ভিতরে রঙ্গিন ছোট্ট ছাতার নিচে এই বর্ষণমুখর বিকেলেও দেখি অনেক জুটি পাখিদের ন্যায় স্নাত হয়ে প্রেমালাপ ও ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত কাটাতে ব্যস্ত।
একই সময়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা থাকায় সে কী লোকারণ্য।! সদ্য ফুটন্ত ফুলের যেরকম অবয়ব সেরকমই অবয়ব উপহার দিয়েছে এই বর্ষা ভর্তিচ্ছু অষ্টাদশীদের। হেঁটেই আসলাম গুলিস্থান। গোটা পথই ডানে-বামে ও সামনে পিছনে ছিল বৃষ্টিস্নাতদের ভিড়।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে আছে মরমী শিল্পী ও কবি দালান জাহানের জন্মোৎসব। তাই বাসে করে বাংলা মটর আসলাম। আটতলার কক্ষে জন্মোৎসবে কবিতা, গান, কেক কাটা ইত্যাদির আনুষ্ঠানিকতা সেরে বের হতে হতে রাত প্রায় দশটা।
সদা হাস্যোজ্জল কবি ও গায়ক সাহেদ এবং কবি ইখতিয়ার হুসাইনকে নিয়ে হাঁটছি কারওয়ান বাজারের দিকে। কত কথা! কত দুষ্টুমী! হালকা বৃষ্টির মাঝেই হাঁটছি আমরা। হঠাতই মনে পড়ল 'মানবকণ্ঠ'র সাহিত্য পাতায় প্রকাশ হয়েছে আমার একটি অনুবাদ। বিশ্ব সাহিত্যের বর্তমান নাম্বার ওয়ান কাজুও ইশিগুরোকে নিয়ে দ্য গার্ডিয়ান'র একটি প্রবন্ধ যা অনুবাদ করেছিলাম।
সারাদিন পরীক্ষা, জন্মোৎসব, আড্ডা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পত্রিকাটি সংগ্রহ করতে পারিনি। তাই সাহেদকে বললাম 'মানবকণ্ঠ' সংগ্রহ করতে হবে। সে বলল ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের সামনে পাওয়া যাবে পত্রিকা। তাই হাঁটলাম আনন্দ সিনেমা হলের গেট পর্যন্ত।
হকারের কাছথেকে পত্রিকাটা নিয়ে চোখ বুলাচ্ছিলাম। চোখগুলো একটু পেপারের বাইরে পড়তেই দেখলাম একজন স্মার্টমেয়ে এই হেমন্তের রাতে পাশের দোকানথেকে বিস্কুট খাচ্ছে। হালকা গোলাপী রঙের লিপগ্লোজ। ম্যাচিং করা ভ্যানিটি। ফ্লাট চপ্পল। একটি মধ্যম ধরণের ফ্রেমের চশমা। ওড়ানাটি মাথায় ও গলায় মাফলারের মতো পেঁচিয়ে কটিপর্যন্ত লম্বিত। সামনের চুলগুলো শ্যাম্পু করার পর একটু উঁচু করে ক্লিপ দিয়ে স্পাউটকরা।
তার চোখদুটোতে চোখ পড়তেই কেনো জানি বিদ্যুত ঝলকানির মতো একটা কিছু খেলা করে গেল আমার ভিতরে। সাতপাঁচ ভাবার অবকাশ না রেখেই পেপারের মূল্য পরিশোধ করে পা বাড়ালাম সামনে। পাচঁ ছ'পা হেঁটে পিছনে আরেকবার তাকালাম। দেখি কী যেন এক ডাক ও দু'চোখে। আমাকে কী জানি বলতে চায়! চপলতা কাছে টানে।
ভেজা রাস্তার ডিভাইডার পার হয়ে ছয় নম্বর বাসে উঠব। রাস্তা পার হতে যেয়ে ইখতিয়ার উদ্দিনের পায়ের সাথে লেগে আমার চপ্পলের একপাটি পড়েগেল। দ্রুতই ডিভাইডারের কাছে গেলাম। চপ্পলের একটি রাস্তায় পড়ে থাকল। তার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল একটি একটি করে বাস, এমা ও মাইক্রো।
চপ্পলের বহিরাঙ্গণে তেমন একটা ক্ষত আলো-আধারিতে দেখা যাচ্ছে না। তবে তার ভিতরের উপাদানগুলোতে ফাঁটল ধরেছে নিশ্চয়।
এ রকম বর্ষণমুখর রাত। ফার্মগেটে তেমন লোকজনের ভিড় নেই। তাই আজকে যে উপার্জন হবে না এটা প্রায় নিশ্চিত। বাসাতে সকালবেলা চাল, ডাল, সব্জি, খোকার খাবার নিয়ে ফিরতে হবে তার।
এ রকম আবেদনময়ী শর নিক্ষেপ করে আগে কাউকে হয়তো সে ডাকেনি। তবুও তার আবেদন আজ ব্যর্থ।
আমি কবি। আমি সুঠাম দেহের অধিকারীও। পকেট জোর কম তাও কিন্তু নয়। কিন্তু আমি পারিনি তার ডাকে সাড়া দিতে।
(ছবিঃ লরি জাস্টাস পেস )