Tuesday, 25 February 2020

কুসুমের মাসের কবিতা ১২


Joseph Stella: Battle of Lights, Coney Island, Mardi Gras (1913-14)

মুলতুবি দেওয়াল বরাবর
                    -সম্পিতা সাহা


হাহাকারের মতো প্রেতঘুম।
জেগে উঠে দেখি গর্ভদণ্ডছায়া খুলে গেছে।
তুমি ঠোঁট খুলে ঘুমাও।
গিলে নাও, কস্তুরিমেঘ নিজের বুকে।
জানালা বেয়ে গতরাতের বৃষ্টি ঝরে পড়ছে... এসো এখন।
এসে দেখো, কত যত্নে বাড়িয়ে তুলছি দাগের কাছে সাম্যতা...

আরোপ থেকে সরে গিয়ে,
সাদা প্লেটে সাজিয়ে আনি প্রাতঃরাশ।
তুমুল যন্ত্রণায় গিলে নিতে পারিনা
মনোহারি পাখির মাংস।

ডুবন্তছায়া...

ঘেমে ওঠে প্ররোচনা।
সমস্ত দরজার মুখে একটা করে
ঘন্টা ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে কেউ।
আসতে যেতে আওয়াজ হয়।
ভাবি ছুটি হয়ে গেছে।
প্রক্ষালনে জাদুপায়রার হাতছানি...
সম্ভবত এখনই মোহ কাটিয়ে উঠবে শরীর।

অতঃপর...

তোমার বিশ্বাসের কাছে এসে দাঁড়াই।
স্বপ্নবৎডিঙা আর আঁধার থেকে
কুড়িয়ে পাওয়া ঘ্রাণ,
তুমি গিঁট মেরে রাখো।
আমার প্রশ্বাস কমে আসে।

তৃণখণ্ডদ্যুতি...

তোমার মায়া হয় না।

হাতে রত্ন পরেও টের পাও না,
আঙুল অসার হয়ে যাচ্ছে দোষারোপের ভ্রমে।

(ছবিঃ যোসেফ স্টেলা )

কুসুমের মাসের কবিতা ১১

Gino Severini: Dancer at Pigalle (1912)

একুশকে বলা
             -পিয়াল রায়

আমার লেখনী ভেসে যাচ্ছে রক্তবমনে
দারিদ্রসীমার বিপজ্জনক নিচে দিয়ে বইছে
আমার অক্ষর
তাদের না আছে ভুত না ভবিষ্যৎ
কাগজ জুড়ে কেবলই হাহাকার
সারাদিনে লক্ষকোটিবার হারানোর গল্প শুধু

এই বাড়িঘর, এই পথ, ওই দরজা ঘুমন্ত দুপুরের
কমলা প্রকৃতির অতীব লাস্যমায়ায়
ত্রস্ত বিজন আমার মগজ-জঠর
জানি না কতদিন আর এইভাবে উপোসী কাটাবে
কতদিন আর ঘাসের ডগায় আঙুল পাকাতে পাকাতে
কর্কশ জল ঘুলিয়ে উঠে আসবে শোক
কানাকড়ি সম্বলহীন ডুবোমানুষের মতো

অভিমানী কাগজে তাই পাক খায় নীলসাদা ধোঁয়া
মস্ত শূন্যতায় নড়েচড়ে
শীর্ণ আয়ুস্রাবী আমার শোণিত তলিয়ে যায়
তলিয়ে যায় বিশদ ক্লান্তির দেশে

এতসব পড়ে পাওয়া নিয়ে আমি
কবিতা পারি না আর
ভণ্ডামি সাধি সাধকের বেশে

(ছবিঃ গিনো সেভেরিনি )

কুসুমের মাসের কবিতা ১০

Umberto Boccioni: The City Rises (1910)

বিয়োগ
        -অভিশ্রুতি রায় ভট্টাচার্য 


একটু একটু করে

ভালো দাও

বাসা দিওনা

বাসা নিজের কাছে রাখো

ওরা বাসা চায় না

শুধু ভালো চায়

ওরা তোমাকে চায়না

শুধু ভালো চায়

ওদের ভালো টুকুই দাও

হাসি দাও

ফল দাও

পরে যাওয়া ফলে দাগ হলে

 গাছও জানতে পারেনা কোনোদিন

(ছবিঃ উমবের্তো বোক্কিওনি) 

কুসুমের মাসের কবিতা ৯



অহন আমরার গায়ে হুদাই 
                              -নীলাব্জ চক্রবর্তী



অহন আমরার গায়ে
হুদাই এই ঢিলাঢালা শব্দগুলি কেম্নে ফিট অইব
ভাষা ফালাইতে ফালাইতে
হেরা গাছ হইয়া উঠতেসে কেম্নে
শাটার অবধি লিখতেসে
যারা মাংসের ভিত্রে গান রাইখা
ভুইল্যা গ্যাসে কাগজের এক একখান দিন
আলো কারখানার পাশেই
বসায়ে রাখসে বুজায়ে ফালান পুকুর
হাওয়ার ভিত্রে
তোমাগো ভাব উড়তেসে দেইখ্যা
ফিজিক্স পড়তে বইসা
পিঠ চুলকানের মস্ত একখান লাঠি দিয়া
ভ্যানোপ্রসাদ আমারে গুলি করনের ভাব করলে
পইড়া যাওনের ভাব করতে করতে
এহানে বইসা বইসা
এই কবিতাডাই লেইখ্যা যাইতে থাকুম
যতক্ষণ না
আমরার পাও আমরার বাপের পাওয়ের লাকান ফুইল্যা ওঠতাসে...

(ছবিঃ গিনো সেভেরিনি )

কুসুমের মাসের কবিতা ৮

Carlo Carrà: Funeral of the Anarchist Galli (1910-11)

সাং 
              -রাজেশ শর্মা 


'মম আঁখি হইতে পয়দা, আসমান জমিন।
আর পয়দা করিল যে, শুনিবারে যত।
সবদ, সাবদ, আওয়াজ ইত্যাদি যে কত।।'

           ----হাসন রাজা


বাড়িতে ফিরে এলে উৎসব হয়। জীবিত অথবা মৃত
দু'রকম উৎসব

মৎস স্পর্শ  হবে বলে  বুড়া লোহিত ডিম ভরে পেটে


বাড়িতে ফিরে এলে। উৎসব হবে। জীবিত অথবা মৃত


দেশি, বিদেশি অথবা ডিটেনশনতাড়িত।

(ছবিঃ কার্লোস কাররা) 

কুসুমের মাসের কবিতা ৭

Image result for futurism painting

সংশ্লেষ
             -মীনাক্ষী  মুখোপাধ্যায়

সন্ধ্যা নেশাতুর হলে জোনাকি উড়ে যায়
 চোখ মুখস্থ করে ঠোঁটের তিল
ঈশান কোণের জরুল

বাস্তুসাপ শিকারে তখন নিশাচর
জিভ থেকে খসতে থাকে লালা

গা পুড়ে যাচ্ছে ধুম তাপে
অথচ জ্বর শূন্য থার্মোমিটার

 খুব ভোরে ডুব দিই পুকুরে
কোচল ভরা কাঁকড়া তুলে আনি
উনুনে নতুন মাটি নিকাই
চুলের জলে ভিজতে থাকে পিঠ

বৃষ্টি পড়ে ...

হাঁড়িতে ফুটতে থাকে ভাত
উথলে ওঠে - ঢাকনা  কাপে
পোড়া কাঁকড়ায় ঘোষতে থাকি নুন লেবু লংকা

হাওয়ায় গামছা উড়লে
আঁশটে ও ঘামের গন্ধ  নাকে এসে লাগে
 মোচড়  দেয় তলপেট

ছাতার নীচে জমে ওঠে কাদা

তাপ পরিমাপের একক ভুলে

এখন

পারদ দেখি থার্মোমিটারের চূড়ান্ত ডিগ্রীতে

( ছবিঃ কাজিমির ম্যালেভিচ )

কুসুমের মাসের কবিতা ৬



মেছো থালা
       -সুতপা চক্রবর্তী


ভালোবাসার বেড়াল হয়ে বুকের মধ্যে
থাকা হয় না
নধর বালকের বাঁশিমুখো ঠোঁটে
বাজে তোর কীর্তনীয়া প্রলাপ
আমার প্রসন্ন বিকেল বল্কলপ্রেম জুড়ে ঝড় বয়
অক্ষরে অক্ষরে স্নান চলে
বারুনিঘাটের

আমরা ভীরুহটি
                   পশ্চিমকোণে

 বেড়ালের আদরমাখা  মেছো থালাটির মতো

(ছবিঃ উমবের্তো বোক্কিওনি )

কুসুমের মাসের কবিতা ৫



প্রলাপ
            -রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ

যুদ্ধ শেষে ধ্যানমগ্ন দৃশ্যে
চৌচির একছত্র বিষণ্ণ টোপ...

বিপণন শর্করা রাতে
হেঁটে যায় ছায়ার প্রলাপ।

(ছবিঃ নাতালিয়া গোঞ্চারোভা )

কুসুমের মাসের কবিতা ৪




ট্রাম্পেট
           -মৌমিতা পাল

'চললুম ', কথাটা কম করে হলেও
সত্তরবার বললাম।

তাকে ভালোবাসি বলে গুলি করব না এমন দিব্যি খাইনি কখনো,পিস্তল উঁচিয়ে ফালা ফালা করে দেব খুলি ,ধুত্তোর গুলি!তেষ্টা মেটাই আগে !
বুকের কোণে বিপন্নতা ঝনকে ওঠে,
তাকে দেখিনি কয়েকশো দিন ।
এক একটা দিন হাজার সমান ,মরেই যাব !
মরেই যাব ,মেরেই যাব ,
যাহোক কিছু করেই যাব!

বুকের কোণে বিপন্নতা ঝনকে ওঠে,
তাকে দেখিনি কয়েকশো দিন ।

একটা লোক ছবিলাল
একটা লোক বাজপাখি
একটা লোক নাবালক
একটা লোক জলভাত
একটা লোক রাজহাঁস
একটা লোক বিষণ্ণ
একটা লোক জঘন্য

এসব চিনতে প্রেম শিখিনি
বুকের কোণে বিপন্নতা ঝনকে ওঠে,
তাকে দেখিনি কয়েকশো দিন ।

চেয়েচিন্তে খুবলে খাব
ভেবেচিন্তে একলা হব
মালবাবুর বউকে বিছানায় তুলব
দেখেই যাব দেখেই যাব
ধরতে দিলে ভোর ফাটাব
অকস্মাৎ পৌছে যাব
                                তার বাড়ী!

নির্ভুল তাক করে ,'চললুম' বলে ফিরে আসব!

(ছবিঃ জুলে শোম্যালৎজিগগ )

কুসুমের মাসের কবিতা ৩



দেখে দেখে লেখা
                 -জ্যোতির্ময় বিশ্বাস



২৯
এই জানুয়ারিতে তিনটি মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে গেলাম
তারাদের ব্যবহৃত রোদ
পড়ে থাকবে নীহারিকা মেডিকেলে। বসার জায়গায়।

৩০
এই জানুয়ারিতে ক'জন নতুন পরিচয়
মালদা থেকে বীরভূম থেকে শিলিগুড়ি থেকে...
জগতের বন্ধু দিয়ে জীবন ভরে যাক।

৩১
দুটি কাজের তুল্য কাজ নেই
দুই, নিখুঁত থাবায় খামচে টেনে লম্পটের মুখোশ খুলে
ফেলা। এক, বাঁধাকপি কাটা।

(ছবিঃ যোসেফ স্টেলা )

কুসুমের মাসের কবিতা ২

Speeding Motorboat - Benedetta Cappa


সাঁতার উদযাপন
                 -শিবু মণ্ডল 


প্রস্তাবিত ভ্রমণের পরিকল্পনা বাতিল করার পরেই আমরা সাঁতার শিখব
জলাশয়ের বার্ষিক উদযাপনে হাঁড়ি চড়বে নক্ষত্রলোকে 
আমাদের জলজ সন্তানেরা পিঠে সৌরআলো ধরে হামাগুড়ি দেবে

সাতবছর ধরে ঢেকে রাখা বিরিয়ানির গন্ধে ম ম আজ তুলে রাখা ছুটিবেলা
তুমি কবুল কর আর একবার!তুমি কবুল কর আর একবার!
তুমি কবুল কর আর একবার!

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তুলে আনা মমি উপত্যকায় পৌরাণিক পরম্পরার ভিড়
আমরা এক সৈনিক ও এক সন্ন্যাসীর মৌন মুহূর্তের সাক্ষী হবো
ধ্যানের নির্জনতায় বারুদের শব্দ ভেঙে দিয়ে

(ছবিঃ বেনেডেট্টা কাপ্পা )


কুসুমের মাসের কবিতা ১

Composition, 1926 - Félix Del Marle

হেমন্ত 
           -রঙ্গন রায়


জানলার নিচে মুরগির খসখস শব্দে এখন আর বিরক্ত লাগছেনা এতটুকু
আলতোভাবে বিকেল নামছে , এরপর ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে পড়বে -
এক অদ্ভুত মন খারাপ আছে এই হেমন্তে
উপভোগ করা যায় , উল্লাস করা যায়না -
প্রতিটি পাখির ভেতর যেন এস্রাজের সুরের মত ছড়িয়ে গেছে ঋতুমতী
না হওয়া হেমন্তের দুপুর -
তারপর রেসকোর্স পাড়ার দিকে , শহরের বাইরের দিকে , মানুষের
আলগা হয়ে আসা ভীড়ের থেকে দূরে , আরোও দূরে ...
রিক্সা থেকে আমার লাফ দিতে ইচ্ছে করে ,
 যেকোনো চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়
আমি ভালো আছি -
আমার কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নিলেও ; আমি ভালো আছি -
কিন্তু একথা সবাই জানে ভালো থাকার কথা কেউ চিৎকার করে বলেনা কখনো
আমার সত্যিই ভীষণ অস্বস্তি হয় ,
রেসকোর্সের এদিকে এখনো রয়ে গিয়েছে ইউরোপিয়ান বাড়ি
ফাঁকা নির্জন একা একা বাড়ি - গাছের খসা পাতা - বিলিতি আলোর শেষ বিন্দু
তার মধ্যে দিয়ে রঙিন পোশাকের নরনারী হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাচ্ছে
ঊনবিংশ শতাব্দীর দিকে ---
আমার এসব একদম ভালো লাগেনা , ভালোবাসার ভেতর ভালোবাসাহীনতা দেখি
এমন সময় তুমি বোলপুর থেকে আদিবাসী মেয়েদের  নাচের ভিডিও পাঠাও ,
সেই সুর  আমার মধ্যে আসে , অদ্ভুত ঘোর তৈরি করে ভেতর ভেতর
প্রখর ইউরোপীয় পাড়ায় বসে পাই
আদিবাসী মেয়েদের চুলের গন্ধ , মাদলের শব্দ ---
অথচ চারপাশের ইউক্যালিপটাস সাদা মুখো সাহেবের মত
আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে , হাসতেই থাকে

(ছবিঃ ফেলিক্স দেল মার্লে )